ঢাকা: ছেলে হারিয়ে প্রথম কয়েক বছর অকাতরে কেঁদেছেন মালেকা বেগম। কিন্তু একটি সময় নিজেকে ‘সৌভাগ্যবতী’ ভাবতে শুরু করেন তিনি।
‘সৌভাগ্যবতী’ ভাববেন-ই বা কেন? তিনি যে বীরশ্রেষ্ঠ ছেলের মা। দেশ-মাতৃকাকে রক্ষা করতে গিয়ে ‘অমর’ হয়ে মাকে গৌরব আর মর্যাদা দিয়ে গেছেন সেই ছেলে।
‘ছেলে অ্যামনে মইল্লে চাইরদিনে ব্যাকে বুলি যায়। আমার ছেলে যুদ্ধে শহীদ অইসে। এতো বছর ফরেও গৌরব হাইয়ের, মানুষ কতো সম্মান দেয় আরে’-এভাবেই বলছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মো. মোস্তফা কামালের মা মোছাম্মৎ মালেকা বেগম।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মায়েদের অনুভূতি অনুমান করে নিজের গৌরব আরও বেশি উপলব্ধি করেন এ শহীদ জননী।
বললেন, ‘সন্তান মরার কষ্ট ম্যালা। কিন্তু পোলার আকামের শরম তো আরও বেশি। কতো শরম পাইতাম, যদি পোলা রাজাকার অইতো, মাইনসে যদি তারে ফাঁসি দিতো!’
শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামালের সাহসিকতার গল্প সারা দেশ জানে। দস্যি ছেলেটির সাহসের গল্প আবারও শোনালেন বীরপ্রসূ মালেকা বেগম। যে ছেলে ১৯৬৭ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, একাত্তরে নিজের সঙ্গীদের বাঁচাতে একা গুলি চালিয়েছেন শত্রুসেনার ওপর।
এক সময় শত্রু খুব কাছে চলে আসে। কামালেরও গুলি ফুরিয়ে যায়। শত্রুর আঘাতে শহীদ হন তিনি। কিন্তু জীবনের বিনিময়ে সঙ্গীদের জীবন বাঁচিয়েছেন, শত্রু তাদের পিছু নেওয়ার সুযোগই পায়নি।
বাংলাদেশ তার ছেলের অবদান ভোলেনি, বীরশ্রেষ্ঠের খেতাব দিয়েছে। তিনি হয়েছেন গর্বিত জননী।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে ভোলা থেকে ঢাকা সেনানিবাসে এসেছিলেন মালেকা বেগম।
বাংলানিউজকে জানালেন, বছরে তিনবার সেনানিবাসে আসেন। বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসা হয় তাকে। পৌঁছেও দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে। প্রতি বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে ছেলের সম্মাননা হাতে পান মা মালেকা বেগম।
এ সময় সেনাবাহিনী প্রধান এগিয়ে এসে ‘মা’ সম্বোধন করে তার কুশলাদি জানতে চান। নিয়মিত খোঁজ-খবরও নেন তিনি। গর্বে বুক ভরে যায় এ শহীদ জননীর। এক ছেলে হারিয়ে হাজার হাজার ছেলে পেয়েছেন তিনি।
এর আগেও বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনী প্রধানরাও এভাবেই শহীদ জননীর খোঁজ-খবর নিয়েছেন।
এবারের সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানেও দেখা গেল, সবার সামনের আসনটিতে বসানো হয়েছে মালেকা বেগমকে।
সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক সবার আগে তার কাছেই এগিয়ে এলেন। শহীদ জননীর হাতে উপহার তুলে দিয়ে বেশ সময় নিয়ে কুশল বিনিময় করলেন তিনি। শুধু মুখের কথায় নয়, বিনীত চোখেও যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সেনাপ্রধান।
মালেকা বেগম জানান, ছেলের সঙ্গে শেষ বিদায়ের স্মৃতি আমৃত্যু ভুলবেন না তিনি।
তার ভাষ্যে, ‘একদিন পোলায় আমারে ডাইকা কাছে বসাইলো। দুই গালে চুমা দিইয়্যা পায়ের কাছে বইসা কইলো- মা, শ্যাখ সাবে ডাইকসে, যুদ্ধে যাই। তোমার ছেলেরে কিন্তু আর ফিরা পাইবা না। তুমি কিন্তু মা একদম কান্দাকাটি করবা না, খালি দোয়া কইরবা। দেশ স্বাধীন অইবো মা, দুনিয়া তোমার পায়ে থাইকবো, দেইখো’।
ঢোক গিলে কান্নাও গিলে নেন মালেকা, বলেন, ‘আঁর এমন সোনার টুকরা ছেলে, আর ফিইরলো না। যা যা কইয়ে গেসে, সইত্য কইয়ে গেসে। ছেলে আঁরে গৌরব দিইয়্যা গেসে। ’
‘হইলা ক’বছর খালি কাইনছি। পাকিস্তানিরা আঁর হোলারে মারি ফালাইলো, বুক খালি করি দিল আমার। ফরে ভাইবলাম, কান্দন কিয়ের? হোলাতো যেকোনো সময় মইরতো। মইরছে গৌরবের মরা, দেশ স্বাধীনে যাই মইরসে। এতো বছর ফরেও হোলার কারণে সম্মান হাইয়ের’।
নিজের বার্ধক্যজনিত শারীরিক অবস্থা জানিয়ে বললেন, ‘রত (চলাচলের সামর্থ্য) নাই, চোহে দেখি না, ওষুধ-ডাক্তর বান্ধা। ’
দুই ছেলে, চার মেয়ের জননী মালেকা বেগমের সন্তানদের মধ্যে এখন বেঁচে আছেন দুই মেয়ে, এক ছেলে।
বেঁচে নেই মোস্তফা কামালের ছেলে মোশাররফ হোসেন বাচ্চুও। ছোট ছেলের ঘরে নাতনি রাজিয়া সুলতানা, তাকে নিয়েই ঢাকায় এসেছেন তিনি।
রাজিয়া জানান, পেনশন, ভাতা, টাকা-পয়সা, রেশন কার্ড বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে সেনাবাহিনী। চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সময় তার দাদির যা প্রয়োজন হয়েছে, সবই দিয়েছে তারা।
শহীদ সিপাহী মো. মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাবার নাম হাবীবুর রহমান। গ্রামের বাড়ি ভোলার দৌলতখানে পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে।
চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন কামাল। ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কুমিল্লায় যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ হন বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৫
এসকেএস/এমএ/এএসআর