ঢাকা: যে চারটি হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে নিজামীর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে যেন সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে সর্বোচ্চ আদালতে এর সপক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেছেন বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
বিশেষ করে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সীমাহীন অপরাধ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ শাস্তিই এ অপরাধের একমাত্র সাজা।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করার পর সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
সোমবার (০৭ ডিসেম্বর) আপিল শুনানির দশম কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন তিনি।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহা) নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চে এ মামলার শুনানি চলছে। অন্য বিচারপতিরা হচ্ছেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যাসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) মোট চারটি অপরাধের দায়ে নিজামীর ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এসব অপরাধের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে ধর্ষণ এবং বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ও। অন্য যে চার অপরাধে নিজামী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন সেগুলোও ছিল হত্যা-গণহত্যার সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনার অপরাধ।
সাংবাদিকদের অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, চারটি চার্জে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেটা যেন বহাল থাকে তার জন্য জোরালো বক্তব্য দিয়েছি। ২, ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগে সাক্ষীরা বলেছেন, নিজামীর উপস্থিতির কথা। আর ১৬ নম্বর অভিযোগ হচ্ছে বুদ্ধিজীবী হত্যার অপরাধ। এ ব্যাপারে শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবাররাই নয় সারাদেশের মানুষ বিচার প্রার্থী। মানুষ ন্যায়বিচার চান। এ অপরাধের সাজা একটাই হতে পারে। সেটা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা।
বুদ্ধিজীবী হত্যায় নিজামী সরাসরি ছিলেন কি-না সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, বিজয়ের উষালগ্নে নভেম্বর মাসে নিজামী আলবদর নিয়ে যে লেখা লিখেছেন তাতে অপকর্মে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সরাসরি মেরেছেন- এমন সাক্ষ্য দিতে হবে সেটা এ আইনে লেখা নেই। তার কর্মে পরিকল্পনা উৎসাহী হলে অপরাধী বলে গণ্য হবে।
শুনানির সময় হিটলারের বিষয়ে কি বলেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হিটলার নিজের হাতে কাউকে মেরেছেন এমন কোনো সাক্ষী নেই। কিন্তু এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পনা করে নিধন করেছেন। একইভাবে আলবদররা মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
নিজামী উত্তেজক বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি যখন ছাত্রসংঘের সভাপতি তখন আলবদর গঠিত হয়। আর তারাই স্বীকার করেছেন, জামায়াতের লোকজনই আলবদরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ছিলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন হচ্ছে এমন মামলা যে মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে হয় অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। তবে অপরাধের মাত্রা অনুসারে সাজা কমে বাড়ে। এখানে বুদ্ধিজীবী হত্যা সীমাহীন অপরাধ।
নিজামী সরাসরি উপস্থিত ছিলেন না আসামিপক্ষের এমন যুক্তির জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মুজাহিদ ও ভারতের ইয়াকুব মেমনের রায় উল্লেখ করেছি। ইয়াকুব মেমন নিজের হাতে কাউকে মারেননি। মেমন ষড়যন্ত্র করেছেন। ১৯ বছর জেল খেটেছেন। এরপর তার ফাঁসি হয়েছে।
নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৮টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
প্রমাণিত চারটি অর্থাৎ সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে গণহত্যা ও প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ (২ নম্বর অভিযোগ), করমজা গ্রামে ১০ জনকে গণহত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ (৪ নম্বর অভিযোগ), ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (১৬ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।
অন্য চারটি অর্থাৎ পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন হত্যা (১ নম্বর অভিযোগ), মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র (৩ নম্বর অভিযোগ), বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
৫ ও ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। এগুলোও ছিল হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উস্কানি ও প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ।
এর আগে গত ০২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের তিনদিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। আর গত ০৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছয় কার্যদিবসে ট্রাইব্যুনালের রায়সহ মামলার নথিপত্র উপস্থাপন শেষ করেন আসামিপক্ষ। নিজামীর পক্ষে শুনানি করেন তার প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এস এম শাহজাহান ও অ্যাডভোকেট-অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন।
সোমবার (০৮ ডিসেম্বর) আসামিপক্ষের জবাবি ও সমাপনী যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে এ আপিল মামলার শুনানি শেষ হওয়ার দিন ধার্য রয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছরের ২৯ অক্টোবর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন নিজামীকে।
এ রায়ের বিরুদ্ধে ২৩ নভেম্বর আপিল করেন নিজামী। ছয় হাজার ২শ’ ৫২ পৃষ্ঠার আপিলে মোট ১শ’ ৬৮টি কারণ দেখিয়ে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছেন তিনি।
তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নিজামীর আপিলের সার-সংক্ষেপ দুই সপ্তাহের মধ্যে দাখিলের জন্য রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। এরপর উভয়পক্ষ সার-সংক্ষেপ জমা দেন।
** রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ
** রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন চলছে
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৫
ইএস/এএসআর