ঢাকা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামালপুরের ৮ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ নুরুল মল্লিকের ছেলে রফিকুজ্জামান মল্লিক। তিনি রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী।
এছাড়াও সাক্ষ্য দিয়েছেন পঞ্চম সাক্ষী জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালের সদস্যের ছেলে এ এফ এম হেদায়েতুল ইসলাম ফারুক।
সাক্ষী দু’জন আসামিদের বিরুদ্ধে ১, ২ ও ৩ নম্বর অভিযোগের ওপর সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র ৩ নম্বর অভিযোগের ওপর সাক্ষ্য দিয়েছেন চতুর্থ সাক্ষী।
মামলার ৮ আসামির মধ্যে দু’জন অ্যাডভোকেট শামসুল হক ওরফে বদর ভাই এবং এস এম ইউসুফ আলী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
পলাতক বাকি ছয়জন হলেন- আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা মো. আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মো. আব্দুল হান্নান, মো. আব্দুল বারী, মো. হারুন ও মো. আবুল কাসেম। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও আত্মসমর্পণের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তারা আত্মসমর্পণ করেননি বা গ্রেফতার হননি।
সোমবার (০৭ ডিসেম্বর) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সাক্ষ্যগ্রহণে সহযোগিতা করেন।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সংক্ষিপ্ত জেরার পর মঙ্গলবার (০৮ ডিসেম্বর) পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
সাক্ষ্যগ্রহণের পর চতুর্থ সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন করেছেন পলাতক মো. আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন ও মো. আব্দুল হান্নানের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার এবং এসএম ইউসুফ আলীর আইনজীবী এসএম মিজানুর রহমান। পঞ্চম সাক্ষীর জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মুলতবি ঘোষণা করা হয়।
এ সময় আসামি মো. আব্দুল বারী, মো. হারুন, আবুল হাসেম ও শামসুল হকের পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আসামিপক্ষের আইনজীবী কুতুবুদ্দিন আহমেদ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত না থাকায় ট্রাইব্যুনাল তা আদেশে লিখে রাখেন।
চতুর্থ সাক্ষী রফিকুজ্জামান মল্লিক তার সাক্ষ্যে জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় দাদা-দাদি, মা-বাবাসহ তার পরিবার জামালপুরের পুরাতন সিঅ্যান্ডবি (বর্তমানে শহীদ নুরুল মল্লিক সড়ক) রোডের দয়াময়ী পাড়ার দু’তলা বিশিষ্ট মল্লিক ভিলায় থাকতেন। সে সময় তার বয়স ছিল ৫ বছর।
১৯৭১ সালের ৯ জুলাই সাক্ষী রফিকুজ্জামান দাদা-দাদীর সঙ্গে নিচতলায় ঘুমিয়েছিলেন। মাঝ রাতে দাদার কান্নায় তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে তিনি দেখতে পান দাদা-দাদি ঘরের দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ একজন তাদের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে।
এ সময় তার দাদা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘শরীফ, মান্নান, আশরাফ তোরা আমার ছেলের ক্ষতি করিস না’।
ঘটনার রাতে বাবার সঙ্গে বসে রাতের খাবার খেয়েছিলেন উল্লেখ করে সাক্ষ্যে রফিকুজ্জামান আরো বলেন, সে রাতে বাবা নুরুল আমিন মল্লিককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে, আলবদরের লোকেরা তার বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।
সাক্ষী বলেন, তার একদিন পর সকালে খবর আসে বাবার মরদেহ ব্রহ্মপুত্রের চাপাতলা ঘাটে পড়ে আছে। দাদা, জেঠাসহ পরিবারের অন্যান্যরা চাপাতলা ঘাটে গিয়ে গুলিবিদ্ধ মরদেহ বাড়িতে না এনে জামালপুর পৌর কবরস্থানে নিয়ে দাফন করেন।
ভয়ে সেদিন তার বাবার মরদেহ বাড়িতে দাফন না করে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী। বাবা হত্যার বিচার চেয়ে সাক্ষ্য শেষ করেন রফিকুজ্জামান মল্লিক। ৫০ বছর বয়সী রফিকুজ্জামান মল্লিক বর্তমানে ব্যবসা করেন।
বর্তমানে ৬৬ বছর বয়সী অপর সাক্ষী হেদায়েতুল ইসলাম ১৯৭১ সালে জামালপুরে পাটের ব্যবসা করতেন। তার বাবা খন্দকার তোজাম্মেল হোসেন ওরফে বাঘা মৌলভী সে সময় জামায়াত করতেন। বাবার রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে সে সময় তিনি আসামি ইউসুফ আলী ও প্রফেসর গণিসহ আরো অনেককেই চিনতেন। সাক্ষ্যে তাদের নামও উল্লেখ করেন সাক্ষী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেলে আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ছিল উল্লেখ করে সাক্ষ্যে তিনি আরো বলেন, ‘স্বাধীনতার পর শুনেছি, আলবদর ক্যাম্পের সঙ্গে আশরাফ, মান্নান, বারী, হারুনরা জড়িত ছিলেন। সেখানে সাধারণ মানুষদের ধরে নিয়ে আটকে রাখা হতো’।
সাক্ষী হেদায়েতুল ইসলাম সাক্ষ্যে শহীদ নুরুল আমিন মল্লিকের গুলিবিদ্ধ মরদেহ ও দাফনের বর্ণনাও তুলে ধরেন।
গত ২৬ অক্টোবর অাট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাট ও মরদেহ গুমের পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত ১৮ নভেম্বর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলার প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন সাংবাদিক আজিজুর রহমান ডল (৫৬)।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৫
এমএইচপি/এএসআর