ঢাকা: বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে। একই অপরাধে রায়ের ধারাবাহিকতায় মতিউর রহমান নিজামীরও ফাঁসি চান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
অপরদিকে যে সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে দেওয়া হয়েছে, তাতে মতিউর রহমান নিজামী খালাস পাবেন বলে আশা করেছেন তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
মঙ্গলবার (০৮ ডিসেম্বর) মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্যের পর সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেছেন দুই পক্ষ।
সোমবার (০৭ ডিসেম্বর) নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রাখার পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। আর মঙ্গলবার এর জবাবে আসামিপক্ষে যুক্তিখণ্ডন করেন নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। এর মধ্য দিয়ে ১১তম কার্যদিবসে আপিল মামলাটির শুনানি শেষ হওয়ায় রায়ের দিন ধার্য করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহা) নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ। অন্য বিচারপতিরা হচ্ছেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি (নিজামী) আলবদরের উদ্দেশ্যে লেখা লিখেছেন আলবদরদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। আলবদরদের আরো কাজে নিয়োজিত হওয়ার জন্য। তাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এ লেখার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ডিসেম্বর বা তার কাছাকাছি সময়ে আলবদরদের হাতে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা জীবন হারিয়েছেন। কাজেই আলবদরদের ব্যাপারে তার যে বক্তব্য সেটা পিনপয়েন্টে।
সুতরাং, এ থেকে নিজামীকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না বলেও মন্তব্য করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।
মাহবুবে আলম বলেন, আলবদর বাহিনী যখন গঠিত হয়, তখন তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। আর ছাত্রসংঘের সদস্যের সমন্বয়ে আলবদর গঠিত হয়।
তাদের (আসামি) পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তিনি অক্টোবর থেকে আর ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন না।
সুতরাং, তার কোনো নেতৃত্ব দেওয়ার আর সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা বলেছি, তিনি নভেম্বর যে লেখা লিখেছেন তাতে দেখা যায়, আলবদরদের ওপর তার কন্ট্রোল ছিলো বলেও মন্তব্য অ্যাটর্নি জেনারেলের।
তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে মতিউর রহমান নিজামী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ড যদি না পান তাহলে আমরা হতাশ হবো।
আপিলে ফাঁসির আবেদন করেছেন কি-না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ।
বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে, একই অপরাধে নিজামীর বিষয়ে কি আশা করছেন- এ প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, মুজাহিদের মামলার রায় আদালতে পেশ করেছি। ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে নিজামী-মুজাহিদ ও গোলাম আযমের নাম ছিলো। যেহেতু একই অপরাধে মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছিলো। তাই রায়ের একই রকম ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে একই অপরাধে নিজামীরও ফাঁসির দাবি করেছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্ত তাদের দাবি, নিজামী উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু আইনে আছে, তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে এসব মামলায় দণ্ড দেওয়া যাবে।
অন্যদিকে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তৎকালীন সময়ে নিজামীর কিছু বক্তব্য তুলে ধরে প্রসিকিউশন বলতে চেয়েছেন তিনি ইনস্টিগেশন(উসকানি) করেছেন। সে কারণে সে দোষী। আমরা বলেছি, সংগ্রাম পত্রিকায় যতোগুলো বক্তব্য এসেছে সবগুলো ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করেছেন। ট্রাইব্যুনাল ওইসব অভিযোগে তাকে খালাস দিয়েছেন।
খন্দকার মাহবুব বলেন, আদালত বলেছেন, অ্যাবেটমেন্টের কথা। আমি বলেছি, অ্যাবেটমেন্টের ঘটনা স্পেসিফিক করতে হবে। কোন অপরাধের বিষয়ে উস্কানি দিয়েছেন। যে ঘটনাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো পাকিস্তানি আর্মিরা করেছে। প্রসিকিউশন থেকে সাক্ষ্য এসেছিলো-নিজামী সঙ্গে ছিলেন। প্রধান আসামি হচ্ছে পাকিস্তানি আর্মি।
এখানে প্রধান আসামির বিচার হচ্ছে না। তখন অ্যাবেটর হিসেবে তার বিচার কতোটুকু সমীচীন? এবং সেখানে আমাদের অ্যাবিলিটি অর্থাৎ পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে আমাদের কন্ট্রোল কতোটুকু বলেও প্রশ্ন করেন খন্দকার মাহবুব।
শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল আলীম চৌধুরী ও ডা. আজহারুল হকের বিষয়ে তিনি বলেন, কথিত মতে তাদেরকে আলবদররা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। আমরা সেখানে বলেছি, ডা. আলীমের স্ত্রী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, আজহারের পক্ষেও সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডা. আলীমের স্ত্রী একটি বই লিখেছিলেন। আজকে আদালতে এসে তিনি বলেছেন, নিজামী সাহেবের নির্দেশে আলবদররা ডা. আলীমকে তুলে নিয়ে গেছে। তার বইয়ে এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ ছিলো না। দুইটা বই। কোনোটাতে এ কথা নেই। একইভাবে আজহারুলের স্ত্রী শাহরিয়ার কবিরের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানেও নিজামীর সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি।
যে সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে, আমরা আশা করি, আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। তিনি খালাস পাবেন বলেও দাবি করেন খন্দকার মাহবুব।
তিনি আরও বলেন, যদি ধরে নেওয়া হয়, তিনি সহযোগী ছিলেন, তাহলেও তাকে যেন লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। আমাদের প্রত্যাশা’ তিনি ন্যায়বিচার পাবেন।
গত ৩০ নভেম্বর থেকে ০২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান। সে সময়ও আসামিপক্ষ বলেন, অপরাধ সংঘটিত হলেও নিজামী সে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন। এরপরও কোনো অভিযোগে যদি আদালত দোষী সাব্যস্ত করেন, তাহলে তাকে যেন চরম দণ্ড দেওয়া না হয়, সে বিষয়ে আদালতে আরজি জানান তারা।
এ আপিল মামলার শুনানি শুরু হয় গত ০৯ সেপ্টেম্বর থেকে। ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছয় কার্যদিবসে ট্রাইব্যুনালের রায়সহ মামলার নথিপত্র উপস্থাপন শেষ করেন আসামিপক্ষ।
নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যাসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৮টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে।
প্রমাণিত চারটি অর্থাৎ সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে গণহত্যা ও প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ (২ নম্বর অভিযোগ), করমজা গ্রামে ১০ জনকে গণহত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ (৪ নম্বর অভিযোগ), ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (১৬ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।
অন্য চারটি অর্থাৎ পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন হত্যা (১ নম্বর অভিযোগ), মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র (৩ নম্বর অভিযোগ), বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৫
ইএস/এএসআর
** নিজামীর আপিল মামলার রায় ৬ জানুয়ারি
** ‘নিজামী দুধে ধোয়া নন’
** নিজামীর ফাঁসি বহাল থাকবে- আশা অ্যাটর্নি জেনারেলের