ফরিদপুর: ‘খাইয়া না খাইয়া দিন যাইতেছে। কারও কাছে দু’টো পয়সার জন্য যাইতে পারি না।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এ কথা বলছিলেন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার ছোটপাইককান্দি গ্রামের মইফুল বিবি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারিয়েছেন তিনি। ছ’বছর আগে দুরারোগ্য ব্যাধিতে মৃত্যু হয়েছে উপার্জনক্ষম সন্তান জাফরেরও। তারপর থেকে ভীষণ কষ্টে দিন কাটছে শহীদ পত্নী মইফুল বিবির।
প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মুক্তির কথা’ চলচ্চিত্র দেখে এবং তার পৌঁছে দেওয়া মইফুলের আবেদনে সাড়া দিয়ে ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছোটপাইককান্দি গ্রামে তাকে দেখতে যান।
সেসময় মইফুলের বাড়িতে যাওয়ার কাঁচা রাস্তাটি ইট দিয়ে পাকা করে দেওয়া হয়। বাড়িতে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। এসবই যেন এখন মইফুলের গলার কাঁটা।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এহন না খাইয়া টাকা জমায়ে বাড়ির বিদ্যুতের বিল দিতে হয়। শেখের বেটি হাসিনা বাড়িতে আসার কারণে গ্রামের মানুষ মনে করে আমারে কত কিছুই না দিয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো ভাতও পাই না। ’
মইফুল বলেন, ‘সে সময় আমারে নগদ দশ হাজার টাকা, বাড়ির উঠানে দুইটা আম গাছ লাগাই দিয়ে গেছিল হাসিনা নিজের হাতে। এছাড়া তো আমি কিছুই পাই নাই। স্বামী শহীদ হইছে। কিন্তু শহীদ পরিবারের কোনো মর্যাদাও পাই নাই। পাওয়ার মধ্যে বৃদ্ধা ভাতার ৩০০ টাকা ছাড়া আর কোন সাহায্য পাই না। ’
এ শহীদ পত্নী প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘এখন তার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মনে যদি চায়, আমার যেন একটু খোঁজ নেন। জাফর (একমাত্র ছেলে) ছিল কোনো সমস্যা ছিল না। ওর মৃত্যুর কারণে আমি বড় একা হয়ে গেছি। ’
মইফুলের আবদার, ‘বেশি কিছু না, আমার বংশ ধর নাতি রে, যাদের উনি কোলে করে আদর কইরা গেছিলেন, তাদের যেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। ওরা তো পয়সার অভাবে লেহাপড়া করতে পারে নাই। তবুও কত জায়গায় লেহাপড়া ছাড়াও তো চাকুরি হয়। আর বয়স হলে আমার নাতনিরে যেন বিয়ের ব্যবস্থা করে। এটাই এহন একমাত্র চিন্তা। ’
মুক্তিযুদ্ধের খানিক স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘বয়স তহন ২৩-২৪ বছর হবে। উনি (স্বামী জলিল মোল্যা) সকালের ভাত খাইয়্যা বাড়ি থেকে বের হইলেন। তারপর দুপুরের আগেই গ্রামের মাঠের মধ্যে হঠাৎ পাকিস্তানি মেলেটারিরা আরও ৬-৭ জনের সঙ্গে আমার জাফরের বাপরেও মেশিনগান দিইয়া ঝাঁজরা কইরা দিয়া গেল। ’
‘তারপর দেড় বছরের জাফররে বুকে জড়ায় নিইয়ে কোনো রকমে কষ্টের মধ্যে জীবনটা কাটাই দিলাম। আমার একমাত্র ধন জাফরও ছয় বছর আগে কী এক অসুখে যেন আমারে ছাইরে চইলা গেল। আল্লাহ আমার বুকটাও খালি কইরা দিল। এহন জাফরের বউ আর চার নাতি-নাতকুর নিয়ে খাইয়া না খাইয়া দিন যাইতেছে। ’
অনেক দেরি হলেও বর্তমান সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন মইফুল। তিনি বলেন, ‘অনেক দেরি হইলো, আরও আগেই বিচার করা উচিত ছিল। আমার মতো কত নারী স্বামীহারা হইছে, কত নারীর ইজ্জত গেছে, যা দুনিয়া জানে তার বিচার হইতে এতো দেরি হইবো ক্যান? একাত্তরের সকল দোষীদের বিচার করতে হবে। তাতে আমার মতো অনেকের স্বামীর আত্মা শান্তি পাইবো। ’
মইফুলের সঙ্গে বাংলানিউজের আলাপ এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন জাফরের স্ত্রী সালমা বেগম। এবার কথার সূত্র ধরে তিনি বলেন, ‘বড় ছেলে সাইফুল (২০) ঢাকায় কাজ করে। মেজো ছেলে ইমামুলও (১৬) কাজ করে। তবে তারা যে টাকা পয়সা দেয় তাতে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত চলে। মেয়ে মাকসুদা আক্তার স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। আর সবার ছোট নাজমুল দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। টাকা পয়সার অভাবে যে দু’জন লেখা পড়া বাদ দিছে, বাকি দু‘জনের অবস্থাও তাদের মতো হতে চলছে। ’
প্রতিবেশী মজিবর রহমান বলেন, ‘খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে পরিবারটা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মইফুলের বাসায় আসার কারণে সবার মধ্যে একটি ভুল ধারণা হয়ে গেছে। কিন্তু ওরা তো তেমন কোন সাহায্য পায় নাই। ’
আরেক প্রতিবেশী ছলেমান মিয়া বলেন, ‘তার জন্য গ্রামের রাস্তা পাইছি। কিন্তু গত ১৫ বছরে আর কোন সংস্কার না হওয়ায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। মইফুলের বাড়ি প্রধানমন্ত্রী আসায় নাম হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। প্রশাসন ও সরকারের উচিত পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
আরকেবি/এইচএ/এটি