বাহুবল থেকে ফিরে: কোনো কোনো স্থানের নামকরণ নিয়ে রয়েছে চমকপ্রদ ইতিহাস। কখনও কখনও ব্যক্তি, স্থান, কালভেদে হয়ে থাকে এসব নামকরণ।
ছোট ছোট টিলা-পাহাড়, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সবুজ বৃক্ষরাজি, চা-বাগান, রাবার বাগান দিয়ে সাজানো ভূ-প্রকৃতি। অনন্য প্রকৃতির কোলে বসবাস করছে অসংখ্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।
প্রাচীনকালে ‘কুদরত মাল’ নামে জনৈক পালোয়ান এ এলাকায় বাস করতেন, যার নামে নামকরণ এই উপজেলার। জনশ্রুতি আছে, মৌলভীবাজার জেলার দক্ষিণ ভাগ থেকে এক পালোয়ান এসেছিলেন বর্তমান বাহুবল উপজেলার কুদরত মালের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে। দুই পালোয়ানের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের মল্লযুদ্ধের পর কুদরত মাল বিজয়ী হয়ে বীরদর্পে বলেছিলেন ‘বাহুকা বল দেখ, বেটা’।
এ ঘটনা স্থানীয়দের মুখে মুখে রটে ছড়া হয়ে যায়, ‘দক্ষিণ ভাগ থেকে আইলো মাল, মির মিরাইয়া চায়, কুদরত মালের ঘুষি খাইয়া গড়াগড়ি যায়’।
কিংবদন্তীর সে মল্লযুদ্ধে ‘দেখ বাহুকা বল’ থেকে আজকের ‘বাহুবল’ উপজেলার নামকরণ বলে জনশ্রুতির পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের তথ্য বইয়ে প্রকাশ করা হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এক কালে এ এলাকার লোকজন খুবই শক্তিশালী ও বীরযোদ্ধা ছিলেন। তখনকার কেউ কোনো ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করতেন না। মল্লযুদ্ধে ৩/৪ হাত লম্বা বড় একটি বাঁশের টুকরা লাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সে বাঁশের লাঠি যার হাত থেকে পড়ে যেতো বা যার লাঠি ভেঙে যেতো সে-ই হতো পরাজিত। তার ওপর আর আঘাত করতো না প্রতিপক্ষ।
জনশ্রুতি আছে, পাহাড়ে বাঘের সঙ্গেও অনেক সময় যুদ্ধ হতো মানুষের। বাঘের হাত থেকে হরিণ ছিনিয়ে আনতেও লোকজন ভয় পেতো না। তাই এ এলাকার মানুষের সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় হিসেবে ‘বাহুবল’ নামের উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
কুদরত মালের ‘বাহুর বল’ থেকে আজকের হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার নামকরণ। শত জাতের বৃক্ষ, টিলা-পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে চা-বাগান অনন্য রূপ দিয়েছে বাহুবল উপজেলাকে।
উত্তরে নবীগঞ্জ, দক্ষিণে চুনারুঘাট, পশ্চিমে হবিগঞ্জ সদর, পূর্বে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, সাতগাঁও এবং দিনারপুরের পাহাড়। খোয়াই, করাঙ্গী, যোজনাল, কালিশিরি নদী, শত শত উপনদী ও শাখা নদী বিধৌত বাহুবল উপজেলা হাওর ও পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক প্রাচীন জনপদ।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য বই সূত্রে জানা যায়, দিনারপুর পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে এক সময় সুখী-সমৃদ্ধ এ জনগোষ্ঠীর আবাস গড়ে উঠেছিল। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে বিপর্যয়ের আগে এ এলাকা ছিল ধন-ধান্যে-সম্পদে-ইতিহাসে-ঐতিহ্যে ভরা।
গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, আর গোয়াল ভরা গরু- প্রবাদটি এ এলাকার ক্ষেত্রেও প্রচলিত ছিল। এ ভূখণ্ডে জন্মেছিল হাজারো ওলি-আউলিয়া, গাউছ-কুতুব, সাধক-সুফী, পীর-দরবেশ ও নায়েবে রাসুল, যারা সভ্যতার লালন-বিকাশ ও সমাজ-সংস্কারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র মতে, বাহুবল উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৩৫টি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে তাদের সাংস্কৃতিক বিচরণ লক্ষণীয়। বিশেষ করে মণিপুরী নৃত্য এ এলাকার নিজস্ব ঐতিহ্য, যা গোটা ভারতবর্ষে বিখ্যাত। এই এলাকার নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী খাসিয়া-কালিগজিয়াদের জীবনযাপনও পর্যটকদের আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রয়েছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থানও।
আলিয়া খাসিয়াপুঞ্জী: মিরপুর বাজার থেকে সড়ক পথে পূর্বদিকে ঢাকা সিলেটের পুরাতন মহাসড়কের মিরপুর-শ্রীমঙ্গলের মাঝামাঝি ‘মুছাই’ নামক স্থান থেকে এক কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করলেই আলিয়া খাসিয়াপুঞ্জী।
চা-বাগান: মিরপুর বাজার থেকে সড়ক পথে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় যাওয়ার পথে দু’পাশে চোখে পড়বে অনেকগুলো চা-বাগান। যা দেখে চোখ ফেরানো যায় না।
রুপাইছড়া রাবার বাগান: বাহুবল বাজার থেকে সড়কপথে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে সিলেট যাওয়ার পথে পুটিজুরী নামক স্থান। এখানে চোখে পড়বে রাবার বাগান ও বাগানে শ্রমিকদের রাবার তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহের চিত্র।
রশিদপুর গ্যাসফিল্ড: মিরপুর বাজার থেকে সড়ক পথে পূর্বদিকে ঢাকা-সিলেট পুরাতন মহাসড়কের মিরপুর হয়ে শ্রীমঙ্গলের দিকে অগ্রসর হলেই রশিদপুর গ্যাসফিল্ড। এটিও দর্শনীয় স্থান।
দ্য প্যালেস: পাঁচ তারকাবিশিষ্ট দ্য প্যালেস রিসোর্টটি এ এলাকায় পর্যটকদের আকষর্ণের অন্যকম বিষয়। এখানে রয়েছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার আবাসিক কক্ষ ও বিনোদনের নানা উপকরণ।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে রেল ও সড়ক পথে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে গেলে ১৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে বাহুবল উপজেলা। ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বা চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে আসতে হবে। সেখান থেকে বাহুবল উপজেলার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
এমআইএইচ/আরএম