কুমিল্লা: ৯ মাসের এক রক্তসাগর পেরিয়ে যে লাল-সবুজের পতাকা আর একটি দেশ আমরা পেয়েছি, তার পেছনে রয়েছে লাখো মানুষের প্রাণ উৎসর্গ আর আত্মত্যাগের অজস্র গল্প।
অজস্র সেই গল্পের অনেকাংশ জুড়েই রয়েছেন লাখো মা ও বোন।
পাক হায়েনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে সম্ভ্রম হারানো কিংবা নির্যাতিত সেই লাখো বীরাঙ্গনা মা-বোনের অনেকেই পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
কিন্তু নানা কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছেন আরো অনেকে। অনেকেরই মেলেনি স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় সুবিধা। নিজ থেকেও অনেকে আর ওই পরিচয় দিতেও আগ্রহ প্রকাশ করেন না।
কুমিল্লা জেলাতেও রয়েছেন এমন হাজারো বীরাঙ্গনা। যাদের বেশিরভাগ রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। বিভিন্ন কারণে তারা পরিচয় দিতে আগ্রহী নন।
সম্প্রতি কুমিল্লা জেলা প্রশাসন ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড এমন ১৫ জন বীরাঙ্গনাকে খুঁজে বের করেছেন। তাদের দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তবে দেশ স্বাধীন হলেও যারা পাননি প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ।
জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তাদের কেটেছে দূর্বিসহভাবে। না রাষ্ট্র, না সমাজ কেউ খোঁজ রাখেনি একটি দেশ, একটি পতাকা অর্জনের পেছনের এই আত্মত্যাগকারীদের।
এমনই ৫ জন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে মহান বিজয় দিবস-২০১৫ উপলক্ষে বাংলানিউজের বিশেষ প্রতিবেদন।
‘দু’বেলা ভাতের অভাব মমতাজ বেগমের’
ওষুধ দূরে থাক, দু’মঠো ভাতও পান না সব সময়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো ভাতাও পাননি এখন পর্যন্ত। পাননি বয়স্ক ভাতাও। তার এ কষ্ট দেখার জন্য কেউ নেই।
বাংলানিউজের কাছে এভাবেই নিজের কষ্ট আর হতাশা ব্যক্ত করেছেন কুমিল্লার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম।
মহান স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসে চলতি বছরে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মিলেছে ৬৫ বছর বয়সী মমতাজ বেগমের।
চলতি বছরের ২২ নভেম্বর কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফিউল আহম্মেদ বাবুল মমতাজ বেগমকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়নপত্র দেন।
কুমিল্লা সদরের কালীবাজার ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামের মনু মিয়ার স্ত্রী মমতাজ বেগম। ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের জননী তিনি।
আলাপকালে জানালেন, ৩ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। অর্থাভাবে ছোট মেয়েকে এখনো বিয়ে দেওয়া হয়নি। ৩ ছেলে অন্যের জমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। অনেকটা অনাহারেই দিন কাটছে তার। এর ওপর রয়েছে ঘাড়ে ব্যথা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ।
এদিকে, সম্প্রতি কুমিল্লার জেলা প্রশাসন মমতাজ বেগমকে ৫ শতক জমি দিয়েছেন। ‘চেষ্টা’ নামে একটি সংগঠন দিয়েছে একটি সেলাই মেশিন।
এ নিয়ে মমতাজ বেগম জানান, জায়গা পেলেও তার তো ঘর নেই। একটি ঘর দরকার, দরকার একটা গাভীও। ঠিকমতো খাবার মেলেনা দুই বেলা। ওষুধ কেনার টাকা নাই।
৭১’র ভয়াবহ সে নির্যাতনের প্রসঙ্গ তুলতেই শিউরে ওঠেন তিনি। জানান, অনেক নির্যাতন চলেছেন তার ওপর। যুদ্ধ শেষে স্বামী তাকে সংসারে রাখতে চাননি। পরে সন্তানদের কথা চিন্তা করে ও আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধে স্বামী তাকে গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীনের পর কতগুলো বছর চলে গেলেও কেউ তার খবর নেয়নি।
মুক্তিযোদ্ধা এ নারী জানান, জমি পেয়েছেন। এখন তাকে একটা ঘর নির্মাণ করে দিলে আর মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা হলেই তার শান্তি।
‘সরকারি জমি বুঝে পাননি তাজিয়া বেগম’
তাজিয়া বেগম (৯০)। বয়সের ভারে ন্যূজ্ব তিনি। হাঁটা-চলা করাও কষ্টকর। শরীরেও বেঁধেছে নানা রোগ। কথা তেমন বলতে পারেন না। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেন।
চান্দিনা উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের বিচুন্দাইরি গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফুল মিয়ার স্ত্রী তিনি। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে তার। বড় ছেলে কৃষিকাজ করে আর ছোট ছেলে অন্ধ। বীরাঙ্গনা এ নারী এ বছর পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
তার বড় ছেলে আব্দুল খালেক জানান, তার মা কোনো ভাতা পান না। ৫ শতক জমি পেয়েছেন। কিন্তু এখনো তা বুঝে পাননি। তাদের থাকার মতো জায়গা নাই। সরকার একটি ঘর নির্মাণ করে দিলে ভালো হতো।
‘স্বামী ঘরে নেয়নি ফুলবানুকে’
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই ডিগ্রি কলেজ রোডের একটি বাড়িতে এখন বাস বীরাঙ্গনা ফুলবানু বেগমের।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাক সেনারা তার সম্ভ্রমহানির পর একটি পা ভেঙে দেয়। পঙ্গু হয়ে যান তিনি। স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বামী আর তাকে গ্রহণ করেননি। ডিভোর্স দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে স্বামী চলে যান। এরপর ছোট ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে জীবনের লড়াই শুরু হয় ফুলবানুর। আর বিয়ে করেননি। স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হলেও গত ৪৪ বছর ধরেই নিরন্তর সংগ্রাম করে চলছে হচ্ছে ফুলবানুকে।
তিনি জানান, অর্থের অভাবে পায়ের চিকিৎসা করাতে পারেননি। লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। ছেলেটি ভ্যান চালায়। তার রোজগারেই কোনোরকমে চলছে সংসার।
ফুলবানু জানান, কিছুদিন আগে ‘চেষ্টা’ নামে একটি সংগঠন একটি সেলাই মেশিন দিয়েছে। কিন্তু এটা দিয়ে কি হবে? নানা রোগে আক্রান্ত হলেও অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না।
‘মৃত্যুর আগে সম্মানী ভাতা পেতে চান বেলা রাণী’
৪৪ বছর ধরে অভাব-অনটন, রোগ-শোকে ভুগছেন। মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন ইজ্জত, স্বামীও। চলতি বছরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মিলেছে। সঙ্গে পেয়েছেন সরকারি জমি।
কিন্তু জায়গা দিয়ে কি লাভ। দুই বেলা খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে তার দরকার অর্থের। তাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাসিক সম্মানী ভাতা চান বেলা রাণী দাস (৬৫)।
বেলা রাণী মুরাদনগর উপজেলার নগরপাড় গ্রামের মৃত নরেন্দ্র চন্দ্র দাসের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেননি তিনি। নিঃসন্তান এই মুক্তিযোদ্ধা বাবা-মার সংসারেই পড়েছিলেন। ৪/৫ বছর আগে বাবা-মা মারা যান। বর্তমানে ভাইয়ের সংসারে থাকছেন তিনি। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসে ৭ মাস আগে তিনি বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
বেলা রাণী জানান, বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনারা তার স্বামীকে হত্যা করে ও তিনি সম্ভ্রম হারান। দেশ স্বাধীন হলেও ভালো নেই তিনি। নানা রোগে ভুগছেন, কিন্তু সামর্থ্যের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
তিনি আরো জানান, এতোদিন তার খোঁজ নেয়নি কেউ। এ বছর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার পর সরকার তাকে ৪ শতক জমি বরাদ্দ দিয়েছে। একটি ঘরও নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু কাজ অর্ধেক শেষ না হতেই ঠিকাদার চলে গেছে।
‘মেয়ের চাকরি ও ভাতা চান মাজেদা খাতুন’
ছোট মেয়েটার জন্য একটা চাকরি আর বাকি জীবনটা ভালোভাবে চলার জন্য সরকারি ভাতা চান দেবিদ্বার উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের মৃত মনু মিয়ার স্ত্রী বীরাঙ্গনা বেগম মাজেদা খাতুন (৬৪)।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে মাজেদা খাতুন জানান, যুদ্ধে হানাদার সেনারা তার ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তার স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়িকে মারধর ও তার সম্ভ্রমহানি করে তারা। এরপরও স্বামী তাকে সংসারে মেনে নিয়েছেন।
তিনি জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট ছোট তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েন। বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালাতে শুরু করেন। এতো বছরে কেউ তার খোঁজ নেয়নি। ৭ মাস আগে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। জেলা প্রশাসন ৫ শতক জমি দিয়েছে।
মাসিক সম্মানী দাবি করে তিনি জানান, সরকার তার ছোট মেয়েটার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে তার আর কোনো সমস্যা থাকে না।
এসব বিষয়ে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফিউল আহম্মেদ বাবুল বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ১৬ জন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করেছি। ১৫ জনকে কাপড়, চিকিৎসা ও খাদ্য সরবরাহ করেছি। পরে জেলা প্রশাসন তাদের জমি দিয়েছে। বীরাঙ্গনারা সম্মানী ভাতা পাবেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী গেজেট করতে বলেছেন।
জেলার বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা বিষয়ে তিনি বলেন, সঠিক সংখ্যা জানা নেই। তবে যুদ্ধের পর কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে প্রায় সাড়ে ৮শ নারীকে বের করে এনেছিলাম।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, ১৫ বীরাঙ্গনাকে ১ দশমিক ০৭ একর সরকারি খাসজমি দেওয়া হয়েছে। দু’একজন এখনো জমিতে যেতে পারেনি বলে খবর পেয়েছি। চেষ্টা করছি এসব বেদখল জমি উদ্ধার করে বীরাঙ্গনা ফিরিতে দিতে। যাদের জমি আছে ঘর নেই, তাদের ঘর নির্মাণ করে দিতে প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রকল্প রয়েছে। সেই প্রকল্পের আওতায় আমরা ওই জমিতে ঘর নির্মাণের ব্যবস্থা করছি।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, বীরাঙ্গনাদের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। অচিরেই তারা নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা পাবেন।
** সেদিনের কথা মনে হলে আজও আঁতকে উঠি
** সংরক্ষণ হয়নি বধ্যভূমি ও গণকবর
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
এসআর