ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

হেডফোন ডেকে আনছে রেললাইনে মৃত্যু

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
হেডফোন ডেকে আনছে রেললাইনে মৃত্যু

ঢাকা: কানে হেডফোন। মোবাইলে বেজে চলছে প্রিয় কোনো গান কিংবা কথা বলছেন প্রিয় কোনো মানুষের সঙ্গে।

আশপাশের কোনো শব্দই কানে ঢুকছে না। হেঁটে চলেছেন রেললাইন ধরে। দূর থেকে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে আসছে ট্রেন। অন্য যাত্রীরা তখন সচেতন হয়ে সরে পড়ছেন।

হেডফোনে গান শুনতে থাকা যুবক তখনও রেললাইন ধরে আনমনে চলছেন হেঁটে। একসময় পেছন থেকে ছুটে আসা ট্রেন মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন করে দেয় একটু আগের টগবগে যুবককে।

সচেতনতার অভাবে এভাবেই প্রতিনিয়ত রেললাইনে ঘটছে দুর্ঘটনা। যার বেশিরভাগই পথচারীদের অসচেতনতায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, হেডফোনে গান শোনার সময় যারা ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেল পুলিশের (জিআরপি) বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের ২ হাজার ৮৭৭ কিমি রেলপথে ১১ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকের মৃত্যু হয়েছে কানে হেডফোন দিয়ে রেললাইন ধরে পথচলায়। অন্য মৃত্যু হয়েছে, রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা, বগি লাইনচ্যুত হওয়া এবং রেললাইনে আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন কারণে।
 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, অনেক যাত্রীকেই দেখা যায় কানে হেডফোন লাগিয়ে হাঁটছেন। এরকম অসেচতনতার কারণে ট্রেনের হুইসেল বাজলেও তারা শুনতে পান না। এমন অসচেতনতা শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ডেকে আনে।

তিনি বলেন, ট্রেনতো আর অল্প দ‍ূরত্বে থামানো যায় না। ন্যূনতম ৪৪০ গজ আগে গতি কমিয়ে থামাতে হয়।

রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, রেললাইনে হাঁটা সম্পূর্ণ বেআইনি। দুনিয়ার কোনো দেশেই রেললাইনে পথচারীরা হাঁটেন না। আমাদের দেশে এটার ব্যতিক্রম। রেলওয়ের পক্ষ থেকে কয়েক জায়গায় আমরা সতর্ক হওয়ার জন্য লিখেও দিয়েছি রেললাইনে না হাঁটতে; কিন্তু পথচারীরা এ বিষয়ে সাবধান না হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে।

চলতি মাসের ১১ তারিখ ঢাকার বনানী রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) ফয়সাল আহমেদ নামে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। জানা যায়, কানে হেডফোন থাকায় ট্রেন আসার শব্দ না শুনতে পেরে কাটা পড়ে মারা যান তিনি।

এরকম আরেকটি ঘটনায় রাজধানীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রের মৃত্যু হয়। গত বছরের ১৫ অক্টোবর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় হেডফোন কানে লাগিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইসমাম তাহমিদ ইশান (২০) মারা যান। কমলাপুর জিআরপি থানা থেকে জানা যায়, ইশান কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে রেললাইন পার হচ্ছিলেন। এর মধ্যেই ট্রেন তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

রাজধানীর বাইরেও এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। গত বছরের ৪ জুন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় মো. সোহেল নামে ১৫ বছরের এক কিশোর কানে হেডফোন দিয়ে রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়।

রেল দুর্ঘটনা ও রেলক্রসিংয়ে মৃত্যু রোধে রেলওয়ের দৃশ্যমান কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। কিন্তু শুধু রেল দুর্ঘটনার মরদেহ উদ্ধারেই বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।

মরদেহপ্রতি কত টাকা কীভাবে খরচ হচ্ছে, দুর্ঘটনা রোধের পরিবর্তে মরদেহ উদ্ধারেই কেন বেশি আগ্রহী এবং বিদ্যমান আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মরদেহ উদ্ধারে কেন এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হচ্ছে- তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই রেল কর্তৃপক্ষের কাছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে রেল চলছে সেই ব্রিটিশ শাসনামলের ১৮৬১ সালের পুরনো আইনে। এই আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রেললাইনের দু’পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কোনো সাধারণ মানুষ কিংবা গবাদি পশু প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। লাইনের দু’পাশের ২০ ফুট এলাকায় সবসময়ই ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে ওই আইনের ১০১ ধারায় গ্রেফতার করা যাবে। গবাদি পশু আটক করে তা বিক্রয় করে সেই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ারও কথা রয়েছে আইনটিতে।

রেলওয়ে আইনের ১২ নম্বর ধারার ‘ঘ’ অনুযায়ী ট্রেনে কাটা মরদেহ ধর্ম ও জাতীয়তা অনুসারে দাফন বা দাহ্য করার জন্য ৮ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমানে একটি মরদেহ উদ্ধার করলে ১৪শ’ টাকা ডোমদের দিতে হয়। যে পুলিশ অফিসার ওই মামলাটি পরিচালনা করেন তাকে দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। মরদেহ উদ্ধার করে মর্গ পর্যন্ত পৌঁছাতে যানবাহন খরচ লাগে আরও প্রায় ৪/৫ হাজার টাকা। কখনও আবার দূরত্ব বুঝে যানবাহন খরচ দিতে হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সব মিলে একেকটি মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পৌঁছানো পর্যন্ত কমপক্ষে ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। রেল দুর্ঘটনার অধিকাংশ মরদেহই টুকরো হয়ে যায়। অজ্ঞাত থাকে অনেকের পরিচয়। অজ্ঞাত মরদেহগুলো আঞ্জুমানে মফিদুলে হস্তান্তর করা হলে তারা বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দেয়।

কমলাপুর জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্ত (ওসি) আবদুল মজিদ বলেন, অসতর্কতার কারণে ইদানীং রেললাইনে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে। অনেকের মৃত্যুর পর মরদেহের সঙ্গে বা কানে হেডফোন পাওয়া গেছে। কানে উচ্চশব্দে গান বাজায় পেছন দিক থেকে ছুটে আসা ট্রেনের শব্দ বা হুইসেল কানে না পৌঁছানোয় মৃত্যু হচ্ছে।

কয়েকটি ঘটনা তদন্তে দেখা যায়, দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে অন্য পথচারীরা বারবার ডেকেও সতর্ক করতে পারেননি। কারণ হোডফোনে গানের তালে আপন মনে হাঁটতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই তার পরিণতি হয়েছে।

জিআরপি জানায়, হেডফোনে উচ্চশব্দে গান বাজলে তখন কানের বাহ্যিক শ্রবণশক্তি একদম হ্রাস পায়। এতে বাইরে থেকে কোনো শব্দ কানে পৌঁছাতে পারে না। ফলে মানুষ তার চারপাশের অনেক কিছুই শুনতে বা টের পান না। তখন রাস্তা পারাপার বা চলাচলের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।

তাই রেললাইনে বা পথচলার সময় কানে হেডফোন কোনোভাবেই ব্যবহার না করার পরামর্শ জিআরপি’র।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
এডিএ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।