ঢাকা: ‘আজ এই ঘোর রক্ত গোধূলীতে দাঁড়িয়ে/ আমি অভিশাপ দিচ্ছি তাদের/ যারা আমার কলিজায় সেঁটে দিয়েছে/ একখানা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ’—দেশের প্রধান কবি প্রয়াত শামসুর রাহমান তার কবিতায় এভাবেই জাতির সূর্যসন্তানদের হত্যাকারী এবং তাদের মদদদাতাদের শাস্তি কামনা করেছেন।
শুধু প্রয়াত এ শ্রেষ্ঠ কবিই নন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া দেশের সকল প্রান্তে একাত্তরের রণধ্বনির মতোই একই আওয়াজ উঠেছে- ‘আর দেরি নয়, বুদ্ধিজীবী হন্তারক অন্য যুদ্ধাপরাধীদেরও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড চাই’।
দেশের প্রধান কবিসহ জনতার দাবি আজ পূরণের পথে। তাই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এবার যোগ হয়েছে ভিন্নমাত্রা। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধীরা আজ সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।
অন্য শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদেরও কয়েকজন কারাগারে ফাঁসির সেলে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। কেউবা দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তবে ফেরারি এসব অপরাধীদের ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্ক মোচনের প্রক্রিয়াও চালাচ্ছে সরকার।
সোমবার ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়েই কাপুরুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশিয় দোসর নরঘাতক রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের ওপর চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। বিশেষ করে ডিসেম্বরে তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা তৈরি করে। এর অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের রাতের আঁধারে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু ১৫ ডিসেম্বর রাতের বিজয়ের উষালগ্ন পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চালায় কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনী। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর নির্মম নির্যাতন-নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে শহীদ হন বুদ্ধিজীবীরা।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যা স্মরণে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের পরের বছর ১৯৭২ সাল থেকেই সশ্রদ্ধ চিত্তে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে আসছে।
স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, পরাজয় তাদের অনিবার্য। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে ওরা বসবাস করতে পারবে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ আবার ফুলে-ফলে ভরে উঠবে। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের বরেণ্য সব ব্যক্তিদের রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয়।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ ফেলে রেখে যায়।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের গলিত ও ক্ষত বিক্ষত মরদেহ খুঁজে পান। বুদ্ধিজীবীদের মরদেহে ছিল আঘাতের চিহ্ন। চোখ, হাত-পা ছিল বাঁধা। কারো কারো শরীরে ছিল একাধিক গুলি। অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে। গলিত মরদেহে ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের মৃতদেহ পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেননি।
একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে সে অনুযায়ী একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
তাদের মধ্যে রয়েছেন- ড. জিসি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য. ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আনম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নতুন চন্দ্র সিংহ, আরপি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, হাবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীনসহ অনেকে।
১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।
যথাযোগ্য মর্যাদা শোকের আবহে সোমবার পালিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ উপলক্ষে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ এবং মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও গোরস্থান এলাকায় নেওয়া হয়েছে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়েছে নানা কর্মসূচি। এর মধ্যে রয়েছে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনাসভা, গান, আবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
এডিএ/এএসআর