ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘প্রাণ বাঁচাতে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল পাকিস্তানি সেনারাও’

নাসির উদ্দিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
‘প্রাণ বাঁচাতে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল পাকিস্তানি সেনারাও’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিলেট: ‘১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। অন্য দিনের মতো বিমান হামলা চালায়নি মিত্রবাহিনী।

একটি বিমান ঢাকার আকাশে বেশ কিছু লিফলেট ছেড়ে ছেড়ে চলে যায়। তখন চারদিক থেকে ঢাকা ঘেরাও হয়ে গেছে। নিয়াজী ও তার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। জেনেভা কনভেনশন আইনে তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে বলেও জানানো হচ্ছিল মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে’।

‘ঢাকা ঘেরাওয়ের পথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন এক পাকিস্তানি মেজর। তাকে আটক করা হলে প্রাণ বাঁচাতে তিনিও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকেন। ’

বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে যুদ্ধদিনের স্মৃতি থেকে কথাগুলো বলছিলেন কমরেড মো. আব্দুল মালেক (এমএ মালেক)। সে সময় প্রাণ বাঁচাতে অন্য পাকিস্তানি সেনারাও জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছিল বলে জানান তিনি।   

মহান মুক্তিযুদ্ধের এ গেরিলা যোদ্ধা এখন বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ও সিলেটের নারী নির্যাতন আদালতের সরকারি কৌশুলি। জেনেভা কনভেনশন চুক্তি অনুযায়ী আত্মসমর্পণ করায় ওই মেজরকে না মেরে বন্দি করেছিলেন তারা।
malek_02
ছাত্র থেকে গেরিলাযোদ্ধা
একাত্তরে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলেন তিনি। মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। তখন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির সংশ্লিষ্টরা এমএ মালেকসহ অন্যদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন।

কমরেড মালেক বলেন, ‘প্রথমে ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয় ইউনিভার্সিটি উদ্যানে। এরপর ঢাকায় ডেমরা ও বাওয়ানি জুট মিল এলাকায় সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া হয়’।

‘অস্ত্র প্রশিক্ষণ আগে থেকেই ছিল। তাই ২৫ মার্চের ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞের রাত থেকে আমরা প্রতিরোধ গড়ি। ওই রাতে রাজারবাগ, পিলখানায় গণহত্যা চালানো হয়। গণহত্যা চালিয়ে ঢাবি’র রোকেয়া হল, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে প্রায় ৭০ জনকে মাটি চাপা দেয় পাকিস্তানি হানাদাররা। ’

২৭ মার্চ কারফিউ শেষে গণহত্যার স্থানগুলো পর্যবেক্ষণ করতে যান মালেক। খুঁজতে থাকেন সঙ্গীদের। তখন কমিউনিস্ট পার্টির লোকজন জড়ো হন। আগে থেকেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল, তাই নতুন করে ট্রেনিং নিতে হয়নি তাকে।   

গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগে ঢাকা থেকে বন্ধুদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ‘স্বাধীনতা’ ও ‘প্রতিরোধ’ নামে দু’টি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন কমরেড মালেক। পত্রিকার সম্পদক ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন জাহাঙ্গীর।

পত্রিকার মাধ্যমে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানাতে শুরু করেন তারা। পত্রিকাটি চলতো দু’হাজারের ওপরে। বর্তমানে এ দু’টি পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

এরপর কলমযুদ্ধ বন্ধ রেখে ঢাকা ২ নম্বর সেক্টরে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, অপারেশন চালান বেশ কয়েকটি।
malek_01
৩০ গেরিলার দল
৩০ জনের একটি গেরিলা দলের মাধ্যমে ঢাকার কাঁঠালবাগানসহ বিভিন্ন এলাকায় খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করেন তারা। গেরিলা দলটির হয়ে যুদ্ধ করেছেন তার বড় ভাই আব্দুল মান্নানও। স্টেনগান, এম-ফর্টিন, স্থলমাইন ও আর্জেস গ্রেনেড ছিল তাদের অস্ত্র।

কমরেড মালেক বলেন, ‘গেরিলা অস্ত্র হিসেবে এগুলো সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে নেওয়া ও হামলা করে সহজে পালিয়েও যাওয়া যেতো। আর পাকিস্তানি হানাদারদের ছিলো ভারি অস্ত্র। গেরিলা যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রের সঙ্গে মোকাবেলা করা সম্ভব হতো না। তাই হামলা করেই পালিয়ে যেতে হতো।

‘গেরিলা যুদ্ধের মূলমন্ত্রই হলো- ‘হিট অ্যান্ড রান’। আপনি দাঁড়িয়েছেন তো মরছেন’- বললেন মালেক।

আদর্শের লড়াইয়ে বন্ধুকে হত্যা
কমরেড মালেক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ‍ ছিলো বাঙালির অস্তিত্ব, আদর্শের লড়াই। সে সময় ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজের একই ক্লাসের ছাত্র রিয়াজ ছিলো আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার বাবা ছিলেন পাকিস্তান গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা। রিয়াজ তাদের (গেরিলা যোদ্ধাদের) অবস্থান ও অস্ত্রাগার চিনে ফেলায় তাকে আটকে রাখি আমরা’।

হার না মানার সেই যুদ্ধে বন্ধুকেও শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে হয়েছিল। কমরেড মালেকে বলেন, ‘আদর্শের লড়াইয়ে আপনজনকেও ছাড় দিতে নেই। সেদিন বন্ধুকে ছেড়ে দিলে আমাদের সবাইকে মরতে হতো। সে তার বাবাকে গিয়ে আমাদের বিষয়ে বলে দিতো’।

হত্যার পর মরদেহ ফেলে দিলেন হাতিরপুল এলাকায়। দেহ ফেলার দায়িত্ব মালেকের ওপরই বর্তায় সেদিন।  

এ কমরেড বলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দিতে নেই। দেশমায়ের জন্য এটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। পরদিন রাজাকার মারা গেছে বলে প্রচার করি। জনগণও এ কথা বিশ্বাস করে’।  

‘যুদ্ধ চলাকালে জনগণের অভূতপূর্ব সমর্থন ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। জনগণ তাদের পথ দেখিয়ে দিতো। জনগণের সহযোগিতা ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ সম্ভব ছিলো না’- বলেন তিনি।

মালেক বলেন, ‘অনেক সময় দায় নিজেদের কাঁধেই নিয়েছেন সাধারণ মানুষ’।
 
এভাবে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান কমরেড মালেক ও তার সহযোদ্ধারা। তাদের এ গেরিলা দলের ৩০ জনই বেঁচে ছিলেন। অবশ্য দু’বছর আগে শাহরিন আহমেদ নামে তার এক সহযোদ্ধা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
Malek_03
ভারতের আত্মত্যাগ
‘যুদ্ধকালীন কিছু বিষয় স্মরণ না করলেই নয়’- বলেন মালেক।

তিনি বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তা না করলে মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হতো। এতে করে আমাদের দেশের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হতে পারতো। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য ভারতের ত্যাগ অনস্বীকার্য। যুদ্ধে তাদের ৩০ হাজার সৈন্য হারাতে হয়েছে’।

সিলেটেও ভারতীয় সৈন্যদের গণকবর রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিদের অবস্থান ছিলো শহরের যতরপুরে। সে সময় বর্তমান গ্যাস অফিসের পাশের দুবড়ি হাওরে ভারতীয় ছত্রি-সেনারা প্যারাসুট দিয়ে নামার সময় তাদের গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। শহীদদের সমাধিও রয়েছে সেখানে।

সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের তাজিদ আলীর নয় ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে কমরেড মালেক দ্বিতীয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বাবা ছিলেন ঢাকায় সিঅ্যান্ডবি’র ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টেন্ট। হাতিরপুল এলাকায় সপরিবারে ছিলেন তারা।

বয়সের ভারে অনেকটা ন্যূজ এ গেরিলা যোদ্ধার দু’টি কিডনিই নষ্ট হওয়ার পথে। চিকিৎসা চলছে। তবু জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়াই করছেন রণাঙ্গনের এ যোদ্ধা, বীর লড়াকু।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
এনইউ/এসকেএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।