সিলেট: চা-বাগানের সবুজ গালিচা লাল হয়েছিলো ২১ চা শ্রমিকের রক্তে। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল একটি কুঁড়েঘরে তাদের আটকে রেখে গুলিতে ঝাঁঝরা করেছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
এ রকম অজস্র রক্তের বন্যায় ভেঙে যায় পাকিস্তানের নোংরা বাঁধ। আসে কাঙ্ক্ষিত বিজয়।
এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। বিজয়ের ৪৫ বছরে বাংলাদেশ। ফাঁক-ফোকর দিয়ে রাজাকাররাও মন্ত্রী হয়ে খামচে ধরেছিলেন লাল-সবুজের পতাকা। অথচ যাদের রক্তে লাল হয়েছিলো খাদিমনগর চা-বাগানের মাটি তাদের স্মৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসেননি কেউ।
শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে স্থানীয়ভাবে নির্মিত হয় একটি স্তম্ভ। এটি তাদের আত্মার জন্য একটি পাওয়া। তবে রক্ষণাবেক্ষণ দূরে থাক, বছর ঘুরে স্বাধীনতা আর বিজয় দিবসেও এতোটুকু শ্রদ্ধা জোটে না সেখানে।
প্রশাসন থেকেও শহীদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি তাদের। খোঁজ নেওয়া হয় না তাদের স্বজনদের। অথচ এ গণহ্ত্যার খবর সবারই জানা।
একাত্তরের সেই ভয়াল দিনে পাকিস্তানি হায়েনারা হত্যার উদ্দেশ্যে ২২ জন চা শ্রমিককে ধরে নিয়ে আটকে রাখে একটি বাঁশ-বেতের ঘরে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয় ২১ জন চা শ্রমিকের বুক। তাদের মধ্যে বেঁচে যান নারায়ণ বল্মিক দাস। তিনি এখন বয়সের ভারে ন্যূজ।
তার বর্ণনায় সেদিনের দুঃসহ স্মৃতির বিবরণ, ‘তখন সকাল ১১টা বাজে। মজুরি দেওয়ার কথা বলে চা-বাগানের সব যুবক শ্রমিকদের একটি কক্ষে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। কিন্তু কক্ষে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন বিষয়। সৈন্যরা বাংলাদেশ নাম বলে বলে গালি দিচ্ছে ও তাদের বুট দিয়ে লাথি দিচ্ছে’।
নারায়ণ বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা তাদের গুলি বহন করতে আমাদের বাধ্য করায়। কিন্তু এতে আমরা রাজি না হওয়ায় গালিগালাজ করে। এক পর্যায়ে ঘরের ভিতরে আটকে রেখে এক ধরনের গ্যাস প্রয়োগ করে। ফলে সারা ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। এরপর আমাদের ওপর গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা। অনেকের শরীর থেকে রক্তের ফিনকি এসে গায়ে পড়ে। আমার ডান হাতেও একটি গুলি লাগে। তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে যাই। তবে ভাবতে পারিনি, আমি বেঁচে যাবো’।
এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের বলতে শুনি, ‘সালে লোগ জয় বাংলা বলেগা তো ডিংলা খায়েগা, বলো গুলি, খায়েগা না গুলি, মারেগা’- বলতে বলতেই কেঁদে ওঠেন নারায়ণ বল্মিক।
’২১ জনের মরদেহ সৎকার করার স্থানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করি। কিন্তু বড় করে ফলকটি নির্মাণ করার জন্য বারবার দাবি জানালেও বাগান কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ’
শহীদ চা শ্রমিকদের স্বজনদের একজন মানিক লাল হাজাম। একাত্তরে হারিয়েছেন বাবা আর ভাইসহ পরিবারের পাঁচজনকে। তার বাবা দুর্গাচরণ হাজাম, বড় ভাই মতি লাল হাজাম, মেজো ভাই হীরা লাল হাজাম, বনোয়ারি হাজাম ও কাকাতো ভাই দিলীপ হাজামকে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনারা।
সেদিন শহীদ হওয়া অন্যরা হলেন- হাড়ো ছত্রী, তৈলা ছত্রী, সুন্দর রবিদাস, চুরু নায়েক, সুরেন্দ্র নায়েক, যুগেস নায়েক, সুরেন্দ্র ছত্রী, রবি বাড়াইক, অনিল খ্রিস্টান, পিরন হাজাম, ছবি ছত্রী, নন্দ কর্মকার, লাল মোহন কর্মকার, রবি বাড়াইক, তিলর হাজাম।
বাবা ও ভাইদের হারানো মানিক লাল হাজাম বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাই। তবে হারাতে হয় আমার পরিবারের সব পুরুষ সদস্যদের। বাবা-ভাইকে হারিয়ে দুঃখ নেই। তাদের প্রাণের বিনিময়ে দেশ পেয়েছি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, অনেক বধ্যভূমির তথ্য ছিলো না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০২১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
এনইউ/এএএন/এসএস/এএসআর
** স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে স্থান পায়নি বৃহত্তম এ গণহত্যা
** লাল সবুজের টানে...
** বাবাসহ পরিবারের ৮ সদস্যের মৃত্যু দেখেছি পাটিতে লুকিয়ে
** মাটি খুঁড়লে এখনও মেলে কঙ্কাল
** ‘রক্তের স্রোতে লাশ ভাসতি দেহিছি’
** অরক্ষিত বধ্যভূমি, নেই গণহত্যার নামফলক