ময়মনসিংহ: রাজিয়া বেগম কমলা। বয়স ৬০ বছর ।
এ নারীর জীবনের সঙ্গে মিশে আছে শত্রু-সেনাদের নৃশংসতার বেদনা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পরেও বীরঙ্গনার তালিকায় তার নাম উঠেনি। জোটেনি কোনো স্বীকৃতিও।
এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কমলার নাম তুলতে মূল্য বাবদ দাবি করেছেন ২ লাখ টাকা। ধার-দেনা করে ২০ হাজার টাকা দিলেও পুরো টাকা না দিতে পারায় ওই তালিকায় এখনো নাম উঠেনি শত্রু সেনাদের বর্বরতার অসহায় শিকার এ বীরঙ্গনার।
উল্টো ঘুষ দাবির এ মানসিক আঘাতও তাকে রীতিমতো আহত করে রেখেছে। একাত্তরের শত্রুদের কবলে পড়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া এ বীর মাতা কঠিন শোকাতাপ করে বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের কমান্ডার মেহেদি হাসান এই নাম তুলতে ২ লাখ টাকা চান। তাদের আমি খরচা বাবদ ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। আর টাকা দেওয়ার সাধ্য তো আমার নেই। ’
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৪ বছরের কিশোরী ছিলেন কমলা। বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার পূর্ব নবাইদ গ্রামে। বাবার নাম আব্দুল আজিজ। এখন থাকেন নগরীর চরকালিবাড়ি এলাকায়। ৬ বছর ধরে আছেন এখানে।
নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড় এলাকার আবাসন পল্লীতে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রবের ফুট ফরমায়েস করেন। মাসে ৩ হাজার টাকা পান। আর দুপুরের খাবার বাবদ পান ২০ টাকা।
বেশিদিন টেকেনি কমলার সংসার। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়ানক এক যুদ্ধ হয়েছিল তার উপর। সেইসব দুঃসহ বেদনার উপাখ্যান উঠে আসে তার কণ্ঠে। বাড়ির কাছে ঝাউখলা বাজারে একদিন এক রাজাকার আমার বাবারে মারধর করে। বলে তোর মেয়ে দিয়ে দে। বাবা বলেন আমার মেয়ে নেই।
বিয়ে দিয়ে দিছি। পরে বাবারে অনেক মারপিট করে রাজাকাররা। কিছুদিন পর বাবা মারা যান। সংগ্রামের সময়ই আমার বাবা আমারে বিয়া দেন।
পাক সেনাদের হাতে নির্যাতিত এ বাঙালি নারী অশ্রুসজল কন্ঠে বলেন, ‘আমার শ্বশুর বাড়ি সাদখালীর পাশেই ছিল পাক বাহিনীর ক্যাম্প। পাকিস্তানিদের ছোড়া গুলিতে আমার চাচি শাশুড়ি মারা যান। পরে আমার শাশুড়ি আমাকে বাবার বাড়িতে দিয়ে আসতে চান।
রাস্তায় পাক বাহিনী আমাদের চোখের সামনেই ৩ জনকে গুলি করে মাইরা ফেলে। ভয়ে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গল দিয়ে নাইম্যা পড়ি। কিন্তু মাথার চুল বাঁশের আগায় আইটকা যায়। আমার শাশুড়ি আমাকে রাইখ্যা পালাইয়্যা যায়। কাঁদতে কাঁদতে বড় রাস্তায় উঠি। উইঠ্যা দেহি একটা ছেলে।
আমাকে কাঁদতে দেখে বাবার বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার কথা কইয়্যা পাক বাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আমারে পাক বাহিনীর হাতে তুইল্ল্যা দেয়। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান বীরঙ্গনা কমলা।
সেইদিনের যন্ত্রণার কথা মাত্র ৪ বছর আগে কম্বোডিয়ায় বলেছিলেন কমলা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে জাতিসংঘে সভা করতে গিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালে রাজাকারদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হালুয়াঘাটে ৩ মাস ছিলেন তিনি। এরপর এক বৃদ্ধার সঙ্গে ময়মনসিংহে চলে আসেন। দেশ স্বাধীন হবার পর একজনের সঙ্গে আবার বিয়ে হয়। কিন্তু ১৬ বছর আগে স্বামী আবুল কাশেম মারা যায়। দুই ছেলে হানিফ (২৫) ও মানিককে (২৪) নিয়ে নগরীর চরকালিবাড়ি এলাকার বস্তিতে থাকেন।
দেশের লাল-সবুজের পতাকায় জড়িয়ে আছে বীরাঙ্গনা কমলার সম্ভ্রম। বলেন, রেজাকারগোর ফাঁসি হইতাছে। বুকটায় কিছুটা শান্তি পাইতাছি। আমগরে সরকার মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিবো। কিন্তু টাকার অভাবে আমার নাম বীরাঙ্গনার তালিকায় উঠতাছে না। এই সম্মানটা লইয়্যাই আমি মরবার চাই।
ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রব বলেন, করিমগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অসহযোগিতা ও আন্তরিকতার অভাবে এ বীর মাতার নাম বীরাঙ্গনা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নির্যাতিত এ নারীর নাম ওই তালিকায় উঠলে তার দুঃসহ যন্ত্রণার ভার কিছুটা হলেও কমবে।
** পথে-পার্কে ইতিহাস ফেরি করেন মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল
** অবৈধ স্থাপনায় আড়াল হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ
** অনাদরে ১০ বধ্যভূমি, নেই সংরক্ষণের উদ্যোগ!
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
বিএস