ধুনট (বগুড়া): দেখতে সুদর্শন। মুখ ভরা দাড়ি ঝুলে পড়েছে বুকের উপর।
দুর্দান্ত উজ্জল ছিল যার তারুণ্যের জীয়নকাঠি। এখন বুকভরা অভিমান ও আক্ষেপই তার একমাত্র পুঁজি।
স্বাধীন দেশের ঊষালগ্নে যেটুকু অবদান রয়েছে, তা নিয়েই আত্মতৃপ্তির সুখ খোঁজেন সেই নিভৃতচারী মানুষটি।
নাম তার আফছার আলী (৭০)। বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার উত্তর কান্তনগর গ্রামে। বর্তমানে স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। মেয়ে ও ছেলেরা বিয়ে-সাদি করে আলাদা সংসার করেন। আর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বাস করেন নিজের বাড়িতে।
তার সহায় সম্বল বলতে চার শতক জমির ওপর বসতঘরটি। প্রায় এক বছর আগে পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস) রোগে আক্রান্ত হয়ে হাত-পায়ের ক্ষতি হয়েছে। আগের মত শক্তি নেই তার হাত-পায়ে।
মুক্তিযুদ্ধের শিহরিত অনুভূতি প্রকাশ করে আফছার আলী বাংলানিউজকে জানান, একাত্তরে উত্তাল সারা দেশ। একদিকে পাক হানাদারদের বাঙালি জাতির ওপর নির্মম অত্যাচার, অন্যদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহান স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধের ঘোষণা। সেই চরম মুহূর্ত কাউকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। এছাড়া বসে থাকারও তো কোনো সুযোগ, মানসিকতা বা পরিবেশ ছিল না। তাই সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা যুদ্ধে।
নিজ গৃহে বসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানান, তখন অশিক্ষিত বেকার যুবক। বাড়ির পাশে বসে যুদ্ধে যাওয়ার পরামর্শ করেন একই গ্রামের শামসুল ও মোজাম্মেলক হক। তাদের পরামর্শে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্ত মা-বাবাকে বললে তো যেতে দিবেন না। তাই আত্মীয়র বাড়িতে বেড়ানোর কথা বলে মাত্র দশ টাকা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হন।
এরপর যমুনা নদী পথে তেঁতুলিয়া সীমান্ত পার হয়ে ভারতে মানকার চরে যান। সেখানে ঘন জঙ্গলে আবৃত জবরিদুয়ার এলাকায় তখন কিছুই নেই। জঙ্গল পরিস্কার করে, ঘর নির্মাণ করে, খেয়ে না খেয়ে শুরু করেন প্রশিক্ষণ। টানা ঊনত্রিশ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল হাতে নেমে পড়েন যুদ্ধে। সেক্টর নম্বর ৬, মুক্তিবর্তা-৯০/৩৬, গেজেট-০৩০৬০৭০০৪৪।
দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে কখনও বিজয়োল্লাসে মাতোয়ারা হয়েছেন, কখনও সহযোদ্ধাদের হারানোর বেদনায় ব্যথিত হয়েছেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও লক্ষ্যচ্যুত হননি, দেশের মাটিকে শত্রু মুক্ত করার দৃঢ় অঙ্গীকার থেকে। যুদ্ধের নয়টি মাস কখনও মৃত্যুভয় হৃদয়ে স্পর্শ করেনি। বরং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই বেঁচে থাকার ভাবনা ছিল।
দেশ স্বাধীনের ১৬দিন পর ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। ঘরে ফিরে বিয়ে-সাদি করে নতুন করে গড়ে তোলেন জীবনযুদ্ধ। কর্মসংস্থানের জন্য তাই কখনো ঢাকা শহরে রিকশা চালাতে হয়েছে। আবার কখনো বা ভাত-কাপড়ের তাগিদে গ্রামের বাড়িতে ফেরি করে হাড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন।
দেশের কাছে কি চাওয়া বা পাওয়ার আছে জানতে চাইলে আফছার আলী বলেন, যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমরা এখনও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক একটি ইতিহাস তুলে ধরতে পারিনি। সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এদেশের মানুষ জানলে তবেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত হবে।
এই দেশ ও জাতির জন্য অনেক অবদান রেখেও নিজ ঘরে তিনি আজ নিভৃতচারী। সহায় সম্বলহীন মানুষটি আজ একা। মুক্তিযোদ্ধার ভাতায় চলে সংসার। অর্থ অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে চিকিৎসা। বিধ্বস্ত ম্লান অবয়বে ক্ষীণ হয়ে আসা চোখে আজ তার অনেক প্রশ্ন ভাসছে। দীর্ঘশ্বাসে ঝরে পড়ছে অব্যক্ত বেদনা। এমন কিছু একটা কি করা যায় না, যাতে তিনি হাসিমুখ দিয়ে আবার বলতে পারেন-জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো...।
বাংলাদেশ সময়: ২২৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
এসএইচ