নারী নির্যাতনা। শব্দ দুটি কানে বাজতেই চোখ তুলে দেখা গেলো সবজি বিক্রেতা একজন নারী, মুখে হাসি ছড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছেন।
শুক্রবার (২৫ ডিসেম্বর) প্রচুর ট্যাংরা মাছ উঠেছে চালনা পৌরসভার বৌমার গাছতলা বাজারে। ৫০ টাকা কেজি দরে তা বিক্রিও হচ্ছে। এত মাছ? সে প্রশ্নে মাছ বিক্রেতার জবাব, এই এলাকায় ট্যাংরা মাছ খুব ধরা পড়ে। সে কারণেই দাম কম।
ঠিক তখনই পাশ থেকে কথা দুটি ছুটে আসে ‘নারী নির্যাতনা’। ততক্ষণে বাংলানিউজের দৃষ্টিও সেদিকে। দোকানি শিপ্রা বিশ্বাস তার পান খাওয়া মুখে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই মাছ ঘরে নিয়ে গেছে তা কুটতে গৃহিনীর কত যে কষ্ট! তা কেবল মেয়েরাই বুঝতে পারবে। এই জন্যই এর নাম দিয়েছি- নারী নির্যাতনা’।
‘বাহ বেশতো!’ বাংলানিউজের অভিব্যক্তিতে কথার খই ফুটলো শিপ্রা বিশ্বাসের কণ্ঠে। অল্পক্ষণেই জানা হয়ে গেলে এই মায়ের গায়ের খাটুনিতে চলে সংসার। তিন মেয়ে। বড় দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভালো ঘরে। তাতে খুশি শিপ্রা বিশ্বাস। তবে তার পরেও সংসারকে টেনে যেতে প্রতিদিন এই বৌমার গাছতলায় সব্জি বিক্রি করতে হয় তাকে। আর এমন ধারা চলছে চার বছরের বেশি সময় ধরে।
সব্জি বিক্রেতাদের যারা পুরুষ, তারা দুর থেকে মাঠে গিয়ে সব্জি কিনে আনতে পারেন, ফলে তাদের বিক্রিতে আয় বেশি। কিন্তু সেটুকু ক্ষতি মেনে নিয়ে এই বাজারে বসেই পাইকারি দরে কিছু কিছু সব্জি কিনে সামান্য মুনাফায় তা বিক্রি করেন। এতে দিনশেষে তার দেড় থেকে দুইশ’ টাকা আয় হয়।
‘ওতেই চলে যায়, বেশি লাভ পাবো কনে? আর আমিতো দূরে দূরে গিয়ে কিনে আনতি পারিনে! তাই যা পাই তাতেই খুশি,’ বললেন শিপ্রা বিশ্বাস। সঙ্গে হাসিখানাতো মুখে লেগেই আছে।
এই আত্মবিশ্বাসী নারী শিক্ষায় খুব এগুতে পারেননি, তবে জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষা তাকে এই শিখিয়েছে, ‘ঘরে বসে থাকলি পরে নারীকে পিছিয়েই থাকতি হবি। সারাজীবন ট্যাংরা মাছ কাটতি হবি। ’
শুধু শিপ্রা বিশ্বাস কেনো যশোর-খুলনা এলাকায় পথে প্রান্তরে নগরে বন্দরে ঘুরে এমন অনেক নারীর দেখা মিললো যারা এখন কোথাও পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, কোথাও নিজে নিজেই লড়ে যাচ্ছেন জীবন যুদ্ধ। তারাও ভূমিকা রেখে চলেছেন দেশের ঘুর্ণায়মান অর্থনীতির চাকায়।
বৌমার গাছতলাতেই দেখা গেলো একটি ফার্মেসিতে স্বামী স্ত্রী এক সঙ্গে বসেছেন সকাল বেলাতেই। একটু এগিয়ে দেখা গেলো পান-সুপারি পসরা সাজিয়ে বসেছেন অপর নারী। নামটি জানাতেও একটু সময় নিলেন লাজুক এই গৃহবধু। কিন্তু তাতে কি প্রতিদিন পালা করে স্বামীর সঙ্গে দোকান করেন। সকালে তিনঘণ্টা, বিকেলে আরও চার ঘণ্টা করে দোকানে বসে স্মৃতিরাণী। পান-সুপুরি-জর্দা বিক্রি করেন। ধান কাটার মওসুম। স্বামীকে ধান কাটতে পাঠিয়ে স্ত্রী এখন সারাদিনই বসেন পানের দোকানে। এত খাটুনি খেটে এসে লোকটার আর শরীরে কুলোবে না, সেই চিন্তাই মুখ্য এই নারীর।
এভাবে পথে-প্রান্তরে আজ নারীরা কাজে লেগে পড়েছেন। পারচালনা পার হয়ে লক্ষীকান্ত গ্রামের দিকটাতে বিশাল জোতে ধান পেকেছে। শত শত মানুষ ধান কাটতে ব্যস্ত। কেউ মাঠে কাস্তে হাতে, কেউ আবার ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে পাকা রাস্তা দিয়ে গ্রামের পথ ধরেছেন।
স্মৃতিরাণীর কথায় যারা ধরে নিয়েছিলেন, পুরুষ ধান কাটবে, নারীরা অপেক্ষাকৃত সহজ ও আরামের কাজ করবে, তাদের জন্য তথ্য হচ্ছে এখানেও নারী। মাঠে কাস্তে হাতে, কিংবা সড়কে ধানের বোঝা মাথায় করে পুরুষের পাশাপাশি সমান জোর কদমে।
কিংবা আরও একটু দুরে এগিয়ে যান। পানখালীতে পারি দিতে হবে ঝপঝপিয়া নদী। সেখানে ফেরির মুখে যে নারীটি গুটি কয় ছফেদা সাজিয়ে বসেছেন। তিনি কিন্তু ওখানে আসেন প্রতিরোজ। আড়াইমাইল দূরে সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষা তার নিজের গ্রাম থেকে। দিনে তার ছফেদা কিংবা পেয়ারা, কিংবা এটা ওটা দেশি ফল বিক্রি থেকে এক থেকে দেড়শ’ টাকা আয় হয়। ক্ষতি কি? দিনশেষে যা আয় হয় তাতে চলে যায়, বললেন এই ফল বিক্রেতা নারী।
খুলনার পথে এগিয়ে যাবেন পাকা সড়ক ধরে আরও কিছুটা দূরে। ততক্ষণে পশুর নদী হাতের ডানে সড়কের সঙ্গে টানা সমান্তরাল বইছে। সেখানেও সেই মনোরম পরিবেশে হয়তো দেখা হয়ে যাবে শাহিনূরের সঙ্গে। তিন বছরের ছেলেটিকে নিয়ে তার স্বপ্ন অনেক। এনজিও থেকে টাকা নিয়ে বাড়ির পাশে তার সব্জি বাগান। টিনের দোচালা ঘরের চাল শিম লাউয়ের গাছে ছেযে গেছে। তাতে সংসারের চাহিদা মেটে, বিক্রি হয়ে ভালো মুনাফা হয়। বাড়িতে সোলার বাতি জ্বলে। সে সবই শাহিনূরের কৃতিত্ব। এবছর নয়, আগামী বছর থেকে ছেলেকে স্কুলে দেবেন।
আর হাতের ডানে কুঁড়ে ঘরের সামনে বসে খুশি মনে বৃদ্ধ জমির আলী যে মাছ বাছাবাছি করছিলেন খুশি মনে, তার কথা শুনলে অবাক হতেই হবে, কারণ পশুর নদীতে ঝাঁকি জাল ফেলে ওই মাছ ধরেছেন তারই ছেলেবউ। তিন ছেলের মেঝটা ‘ভাদাইম্যা’। বউই তাই সংসারের হাল ধরেছে। নদীতে জাল ফেলে দিনে এক-দেড়শ’ টাকার মাঝ পেয়েই যান। তাতে সংসার চলে। আবার ঘরের জন্যও জোটে মাছের পুষ্টি।
যশোর খুলনা অঞ্চলে ঘুরলে এমন হাজারো নারীর দেখা মিলবে। যারা মাঠে কাজ করছেন, হাটে তরকারি বিক্রি করছেন, জলায় মাছ ধরছেন কিংবা দোকান সাজিয়ে চা-রুটি বিক্রি করছেন।
খুলনা রেলস্টেশনের আয়েশা বেগমের কথাই ধরা যাক। স্টেশনের বাইরে তার চায়ের দোকানে ভিড় লেগেই থাকে। দক্ষ হাতে স্বাদের চা বানান আয়েশা বেগম। তাতে দিনে আয় তিন থেকে চার শ’ টাকা। তাতেই ছেলে মেয়েরা লেখা পড়া শিখছে।
এভাবে কেউ নিজেই নেমে পড়েছেন জীবন যুদ্ধে, কেউবা স্বামীর সহায়ক ভূমিকায় নেমেছেন, যাতে দুজনে মিলে আয় করে ভালো থাকা যায়। ঢাকা থেকে খুলনার পথে চিড়েভাজা বিক্রেতা সুলতানের কথা বলা যায়। তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন, স্ত্রীর সহায়তায় আউশের সুস্বাদু চিড়ে ভেজে প্রতিদিন ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করেন তিনি। আয়ের কৃতিত্বে সমান ভাগ স্ত্রীকে দিতে কার্পণ্য নেই সুলতানের। বলেছিলেন, আমার আর কতটুকুই কষ্ট। প্রতিদিন ১০ কেজি চালের চিড়ে তৈরি করতে তার স্ত্রীকে খাটতে হয় সেই ভোররাত থেকে। আর তারই সুচারু হাতে ভাজা চিড়ে জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব হয়েছে ট্রেনে ট্রেনে।
অথবা বলা যায় দাকোপের পারচালনা গ্রামের মুড়ি ভাজার কারিগর হাওয়া বিবি ও তাসলিমা বেগমের কথাও। দিনে ১২৫ টাকা মজুরিতে যারা দিনভর মুড়ি ভাজেন। যাতে একমন করে চালের মুড়ি ভাজতে পারেন। হাওয়া বিবির ছেলেটি স্কুলে যায়। তাকে নিয়ে তার স্বপ্ন অনেক।
অথবা যশোরের তেজরোল গ্রামের খেজুরের রস বিক্রেতা গাছির বউ, যার শ্রমের অংশটি শুরু হয় সকালে গাছ থেকে রস নামিয়ে আনার পরে। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার সুক্ষ্ম গুণী হাতে তৈরি হয় নলেনগুড়-পাটালি। বাজারে যা ভালোদরে বিক্রি করেন গাছি শাহিনুর। করেন বাড়তি মুনাফা।
এদের অনেকেরই, বলা যায় প্রায় সকলের এই চেষ্টার মূল উদ্দেশ্য ছেলেমেয়ের সুশিক্ষা নিশ্চিত করা। সবারই মুখে একটি কথা এই কষ্টে তাদের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।
সাহস দিয়েছে প্রেরণা দিয়েছে বিজয়া লক্ষ্মী নারী, বলে কবি নজরুলের সেই গানকেও পুরোনো করে দিয়ে নারী আজ আর প্রেরণাদায়ীই কেবল নয়, মাঠে, ঘাটে, হাঁটে পুরুষের সঙ্গে সমান যোদ্ধা। দেশ এগিয়ে যাবেই।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৬
এমএমকে