ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ছেলেমেয়ে থেকেও নেই!

মহিউদ্দিন মাহমুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৬
ছেলেমেয়ে থেকেও নেই! ছবি: জিএম মুজিবুর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ঘড়ির কাটায় রাত দুইটা। মাথায় মাটির টুকরি নিয়ে ছুটছেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শফিউল ইসলাম।

বয়স আর শরীরের অক্ষমতার বিরুদ্ধে ভারী কাজের চাপ সামাল দিতে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন তিনি।

রাজধানী গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকায় সিটি করপোরেশনের স্যুয়ারেজ উন্নয়নের কাজ চলছে। ড্রেনেজ সংস্কারের জন্য মাটি খনন করে রাস্তায় রাখা হয়েছে। সেই মাটি সরানোর কাজ করছেন শ্রমিকরা। আবুল অ্যান্ড ব্রাদার কোম্পানির অধীনে সিটি করপোরেশনের কাজ করছেন তারা।

রোববার (৩০ অক্টোবর) দিবাগত রাতে সরেজমিনে গেলে এ দৃশ্য দেখা যায়।

যেখানে রুমা, ফাতেমা, শফিউল ইসলামের মতো বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ কাজ করছেন। কাজের তাড়ানায় কথা বলার ফুসরত নেই কারো।

কর্মী দলে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি নেত্রকোনার শফিউল ইসলাম। তিনি রাজধানী বাড্ডায় থাকেন। তার বয়স ৮০ বছর বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন তিনি।

মাটির টুকরি মাথায় নিয়ে বৃদ্ধ শফিউল ইসলাম যখন টলতে টলতে ট্রাকের দিকে এগিয়ে যান মনে হয় এই টুকরি হেলে পড়লেন। শরীরের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে তিনি বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছিলেন।

সংক্ষিপ্ত আলাপে শফিউল বলেন, গত  ৮ বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন। সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিন রাতেই তিনি কাজের পিছনে ছুটেন।

প্রতি রাতে কয় ট্রাক ময়লা বা মাটি সরানোর কাজ করা হলো তার ওপর ভিত্তি করে দুই’শ থেকে তিন, সাড়ে তিন’শ টাকা পান তিনি।

পরিবার সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবই আছে। স্ত্রী, তিন ছেলে, চার মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী অসুস্থ।

এই বয়সে কাজ করা বিষয়ে শফিউল ইসলাম বলেন, এখনতো বয়স হয়ে গেছে কাজ করতে কষ্ট হয়। মাটির টুকরি মাথায় নিলে পা চলতে চায় না, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু কি করবো কাজ না করলে খাবো কি?

ছেলে মেয়েদের বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ছেলেমেয়েরা থাকতেও নেই। ছেলেমেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে। আমাদের দেখার সুযোগ পায় না তারা।

শফিউল ইসলামের মতো ফাতেমা বেগম, আফিফা বেগমদেরও আলাদা আলাদা গল্প আছে। কর্মীদের মাঝে যে কয়েকজন বেশি বয়সী নারী পুরুষ রয়েছেন সবার জীবনে রয়েছে নানা কারণে নানা কষ্ট।

তারা বেঁচে থাকার তাগিদে বয়স আর শারীরিক অক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু আর কতদিন করতে পারবেন সেটা তারা নিজেরাও জানেন না।

আরেকটু কথা বলার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু ট্রাক ছেড়ে দিচ্ছে, কথা বললে নাকি তাদের কাজের ক্ষতি হবে। তাই কথা না বাড়িয়ে মাটি‍ বোঝাই ট্রাকে মাটির ওপর চড়ে বসলেন সবাই। তার রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলেন।

সত্যিই কি কাজের তাড়া? নাকি সন্তানদের কথা উঠতেই সেই অজানা ব্যথা কাউকে বলবেন না, পেছনে কথা বললে সন্তানদের অমঙ্গল হয় কিংবা অপমান হয় সেই জন্যই কি চলে যাওয়ার তাড়া? জানি না।

বৃদ্ধ বাবা-মায়ের‍া সন্তানদের কাছে কি খুব বেশি কিছু চায়? সবাইকে একটু কাছে ‍পাওয়া, জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত শরীরকে কিছু বিশ্রাম দেয়া এর বেশি কিছু না।

ফাতেমা বেগম থাকেন রাজধানীর গোড়ান এলাকায়। তার বাড়িও নেত্রকোনায়। তার পরিবারের উপার্জন ক্ষম লোক নেই তাই তাকেই হাড় ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়।

তার ৫৫ বছর বলে জানান তিনি।

ফাতেমা বেগম বলেন, কি করবো বাপু কাজ না করলে বাঁচবো কি করে।

দলে বয়সে তরুণ সদস্যও রয়েছে। তাদের একজন হাবিব মিয়া বলেন, আমাদের কাজ করতে খুব একটা সমস্যা হয় না। রাতে ঘুম না যাওয়াটাই কষ্টের। আমাদের এখন সয়ে গেছে।

তিনি জানান, রাত ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই তারা কাজে নেমে পড়েন এবং ভোর ৬টা পর্যন্ত কাজ করতে থাকেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৬
এমইউএম/বিএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।