ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

শিক্ষার আলোয় বদলে যাচ্ছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৬
শিক্ষার আলোয় বদলে যাচ্ছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন  ছবি:অনিক খান-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: মূলধারার মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা। এক সময়ের পশ্চাৎপদ আদিবাসী সম্প্রদায়ের সন্তানেরা এখন বই হাতে স্কুলে যাচ্ছে।

আদিবাসী সন্তানরা হয়ে উঠছে শিক্ষার আলোয় আলোকিত।

এতে করে তাদের জীবনটাও বদলে যাচ্ছে। সামাজিকভাবেও সম্মান বাড়ছে। সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছেন তারা। পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করছে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার আদিবাসী গ্রামগুলোতে।

সম্প্রতি হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া, সন্ধ্যাকুড়া, মনিকুড়া, আচকিপাড়াসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেলো এমন চিত্র।

স্থানীয় আদিবাসীরা জানান, এক সময় মূলধারার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল সীমান্তবর্তী এ উপজেলার গারো সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোররা। বিদ্যালয়ের চৌকাঠ থেকে যারা এক সময় দূরে ছিল, এখন তারাই পড়াশোনা করে আদিবাসী পরিবারের সম্মান বাড়াচ্ছে।

স্থানীয় জয়রামকুড়া মিশন হাসপাতালের বিপরীতে পলি রেমার (৩৫) বাড়ি। পড়াশোনা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। তার মা নির্মলা রেমা (৬৫) নিজেও শিক্ষিত। পলি রেমার তিন সন্তান জেমস মিত্র (১৯), পান্থ মিত্র (১২) ও জেবা মিত্র (১৪) স্থানীয় উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ, জয়রামকুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্থানীয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ছে।

পলি রেমার স্বামী স্থানীয় হ্যাচারি ব্যবসায়ী নোলান মিত্র (৪৫) জানালেন শিক্ষার আলোয় এখানকার আধিবাসী সন্তানদের বদলে যাবার কথা। তার ভাষ্য- সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গারো ছেলে-মেয়েরা শিক্ষায় দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষাতেও তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। গারো ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এখন শিক্ষার হারও প্রায় ৯০ শতাংশ। নোলান মিত্রের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বৃদ্ধ নির্মলা রেমা (৬৫) জানান, তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ সময়ে সন্তানদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

এক সময় বিদ্যালয়ের অভাব শিশুদের শিক্ষা লাভের পথে প্রধান বাধা ছিল। এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলের কোন কমতি নেই। মানসম্মত পড়াশুনা করে আধিবাসী তরুণ-তরুণীরা সংসারে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাও ফিরিযে আনছে।

নির্মলা রেমার এক সন্তান সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলেও জানান তিনি।

স্থানীয় দক্ষিণ মনিকুড়া গ্রামে বিরলা নকরেকের বাড়ি। ষাটোর্ধ্ব বিরলা নকরেক কৃষি জমিতে কাজ করেন। অভাবের সংসার হওয়ায় পেট ভরে তিন বেলা খেতে পারেন না।

কিন্তু সব প্রতিকূলতার মধ্যেও একমাত্র নাতি প্রশংসা নকরেককে নিয়মিতই স্থানীয় জয়রাকমুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন তিনি।

বিরলা নকরেক বাংলানিউজকে বলেন, নিজে পড়াশোনা করতে পারিনি। মেয়েকেও পড়াতে পারিনি। কিন্তু লেখাপড়া না জানলে এখনকার সমাজে টিকে থাকা কঠিন। এ কারণেই নাতিকে স্কুলে পড়াচ্ছি। এক সময় ওরাই সমাজকে বদলে দেবে।

পলি রেমা কিংবা বিরলা নকরেকের সন্তানদের মতো স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় সব পরিবারের ছেলে মেয়েই এখন হয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, নয়তো উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করছে।

একই গ্রামের লিপ্টন ঘাগড়া (৪৫) শ্রমজীবি। তিনি জানান, ‘তার দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে দু’জনই স্কুলে পড়ছে। অন্ধকার কুসংস্কারে নতুন প্রজন্ম বিশ্বাস করে না। পড়াশোনার মধ্যে দিয়েই তারা নিজেদের বদলাতে চায়। আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে চায়।

স্থানীয় জয়রামকুড়া গ্রামের বাসিন্দা জর্জ সলেমার বাংলানিউজকে বলেন, সেইদিন আর নেই। এখন বিভিন্ন এনজিও বা সংস্থার সহযোগিতায় আদিবাসী সন্তানরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে।

উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাদের পদচারণা রয়েছে। শিক্ষিত হবার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও নিজেদের অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে তারা।

আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হালুয়াঘাট উপজেলা ট্রাইব্যাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ভদ্রং ম্রং বাংলানিউজকে জানান, শিক্ষার প্রসার ঘটার কারণেই গারো ছেলে-মেয়েদের জীবনযাত্রাতেও পরিবর্তন এসেছে।

পরিবারের মা-বাবা’র উৎসাহেই ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও পড়ালেখায় এগিয়ে যাচ্ছে। এতে করে আদিবাসী পরিবারের সামাজিক মূল্যায়নও বাড়ছে বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৬
এমএএএম/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।