ঢাকা, সোমবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘আচিক’ ভাষা বলতে পারে, লিখতে পারে  না গারো শিশু-কিশোররা! 

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৬
‘আচিক’ ভাষা বলতে পারে, লিখতে পারে  না গারো শিশু-কিশোররা!  ছবি- অনিক খান, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) ঘুরে এসে:  গারো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ‘আচিক’। স্কুল-কলেজে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করতে হয় বলে গারো শিশু-কিশোররা মায়ের ভাষা ব্যবহারের সুযোগ পায় না।

 

নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ে এ ভাষার ব্যবহার কিছুটা থাকলেও তারা মাতৃভাষায় লিখতে পারে না।  

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় পাঠদানের সুযোগ বঞ্চিত হয়ে আবার অনেক শিশু উ‍ৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। সরকারি বা বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় অনেকটাই বিপন্ন হতে বসেছে আচিক ভাষা।  

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলার সঙ্গে আচিকের মিশ্রণে এ ভাষার মৌলিকত্বও হারাতে বসেছে।  

আচিক শব্দের অর্থ পাহাড়। সত্তরের দশকে জন তুশিং রিছিল এবং নব্বইয়ের দশকে দানিয়েল, মার্টিন রেমা অরুণ রিছিল নিরন্তর গবেষণা করে আচিক বর্ণমালার উদ্ভাবন করেন। এক সময় এ ভাষায় পুঁথি-পুস্তক থাকলেও গারোদের এ বর্ণমালা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে।

ময়মনসিংহের গারো অধ্যুষিত হালুয়াঘাট উপজেলার জয়রামকুড়া, সন্ধ্যাকুড়া, মনিকুড়া, আচকিপাড়াসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে জানা গেছে, নিজের মাতৃভাষায় পড়াশোনা করতে চায় এসব শিশু-কিশোররা। তাদের অভিভাবকেরাও চান, নিজস্ব বর্ণমালায় পরিচিত হয়ে উঠুক তাদের সন্তানেরা।  

জয়রামকুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে শিশু অর্পিতা রেমা। মা আলিভিয়া রেমা (৪০) নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও তার সন্তান এ ভাষায় কথা বলতে পারে না! অভ্যাস ও চর্চা না থাকায় মায়ের বুলিতে বড় হয়ে উঠছে না এখানকার অন্য শিশুরাও।  

সাবেক এনজিও কর্মী অলিভিয়া রেমা বাংলানিউজকে বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম আচিক ভাষার সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে না। আমাদের মুখ থেকে শুনে ওরা একটু-আধটু বলতে পারে। কিন্তু খাতা-কলমে এ ভাষার অস্তিত্ব নেই’।  

তিনি জানান, পাঠ্যপুস্তকের মতো শ্রেণিকক্ষে বাংলায় পাঠদান করেন শিক্ষকরা। ফলে শুরুতেই আদিবাসী শিশুরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অনেক শিশু মায়ের ভাষা শুনতে না পেরে বিদ্যালয়ে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়।  

অথচ মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা হলে শিশুদের মাঝে আরো আগ্রহ তৈরি হতো। এ ভাষা রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।  

স্থানীয়রা জানান, বছর তিনেক আগেও কারিতাসের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশু শিক্ষার্থীদের এ ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু দাতা সংস্থার অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ শিক্ষাদান বন্ধ হয়ে গেছে।  

দক্ষিণ মনিকুড়া গ্রামের গৌরব নকরেক ও জাকুব মান্দা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গৌরব নকরেক বলেন, ‘প্রথমদিকে শিক্ষকরা আমার কথা বুঝতেন না। তাদের পাঠদান বুঝতে আমারও অনেক সমস্যা হতো। এক সময় ভাবছিলাম, বিদ্যালয়ে যাওয়াই বন্ধ করে দেবো। কিন্তু ভবিষ্যত কর্মজীবনের কথা ভেবে বাংলা মাধ্যমেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হচ্ছে’।  

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জাকুব মান্দার ভাষ্য, ‘মাতৃভাষায় আমরা কথা বলতে, বিভিন্ন বিষয়ের উত্তর দিতে পারলেও লেখার সামর্থ্য নেই’।  

একই গ্রামের শান্তা হাগিদক ও তার স্বামী নিক্সন নকরেক বলেন, ‘অভ্যাস না থাকায় আচিক ভাষা উচ্চারণ করাটাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে’।  

এ দম্পতির সন্তান হারা নকরেককে মায়ের ভাষায় কথা বলতে বললে লজ্জায় মুখ লুকায়। অনেক কষ্টে একটি শব্দ উচ্চারণ করে বলে- ‘সাজেক (খাইছি)’।  

চাকরি জীবনে আচিক ভাষার কোনো মূল্য না থাকায় এ নিজের মায়ের ভাষাকে এখন আর ‘অর্থকরী’ ভাষাও মনে করে না আদিবাসী শিশু-কিশোররা।  


হালুয়াঘাট উপজেলা ট্রাইব্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ভদ্রং ম্রং বাংলানিউজকে বলেন, ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।  

তিনি বলেন, আদিবাসী শিশুদের অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। সরকারের উচিত, দ্রুত এ উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন করা। নয়তো আচিক ভাষা ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৬ 
এমএএএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।