ঢাকা, সোমবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

কেন্দ্রীয় কারাগার, স্মৃতিবিজড়িত বিষণ্ন মনের ঠিকানা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৬
কেন্দ্রীয় কারাগার, স্মৃতিবিজড়িত বিষণ্ন মনের ঠিকানা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘রেনু, শুরুতে ভালোবাসা নিও......। রেহানা খুব দুষ্টু ওকে স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে।

এখানে একাকী থাকতে একটু কষ্ট প্রথম প্রথম হতো এখন অভ্যাস হয়ে গেছে...। বসে বসে বই পড়। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ইতি, তোমার মুজিব’ 

চিঠির শেষাংশ পড়তে পড়তে হঠাৎ অস্পষ্ট হয়ে এলো লাইনগুলো। ঝাপসা চোখে স্পষ্ট হয়ে উঁকি দিলো সেই দিন। মনে করিয়ে দিলো, এই তো সেই জেল যেখানে বসে প্রিয় স্ত্রীর কাছে এ চিঠি লিখেছিলেন জাতির জনক।

বলছিলাম, জেলখানার ভেতরের হাসনাহেনা সেলের কথা। দেশের জন্য যেখানে জীবনের ১৬টি বছর কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কদিন আগেও এই জেলখানা ছিলো কারাবন্দিদের আবাস্থল। ২শ ২৮ বছর পর ১০ এপ্রিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ঠিকানা বদলে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই স্থানটি দেখার সৌভাগ্য হলো। সৌভাগ্য হলো, বঙ্গবন্ধুর হাতে লাগানো কামিনী ফুলের গাছটি দেখার। যার সামনে  দাড়ালে বিষণ্ন হয়ে ওঠে মন।

এবার ফিরি মূল গল্পে। এখন ২০১৬ এর ০২ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ০৩ নভেম্বর মাসেই জাতিকে নেতাশূন্য করতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান- এই চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় কারাগারেই। এরপর থেকেই ০৩ নভেম্বর পালিত হয় জেল হত্যা দিবস হিসেবে।  

ঠিকানা বদলের পর সেচ্ছাসেবক সংগঠন জার্নির উদ্যোগে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় কারাগারে আয়োজিত হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। আয়োজনটি উন্মুক্ত করা হয়েছে জনসাধারণের জন্য। এছাড়াও সরকারের সিদ্ধান্তে আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে এ কারাগার। এর অংশ হিসেবে নির্মিত হয়েছে ‘জাতীয় চার নেতা কারা স্মৃতি জাদুঘর ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কারাগার।  
  
পহেলা নভেম্বর এ উপলক্ষে মঙ্গলবার (০১ নভেম্বর) এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন- অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, আইজি প্রিজন সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, স্বরাষ্ট্রসচিব হাজী সেলিমস প্রমুখ।

জেলহত্যা দিসব উপলক্ষে কারাগারের ভেতরের অংশের নানা স্থানে সাজানো হয়েছে যুদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার বিভিন্ন আলোকচিত্র দিয়ে। এতে এমন কিছু চিত্র রাখা হয়েছে যা এর আগে কোনো প্রদর্শনীতে দেখানো হয়নি বলে জানিয়েছেন আয়োজক সংগঠন।

একনজরে জেলখানা
কারাগারে প্রবেশের শুরুতেই দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চেয়ার। সেই স্থানটি ঘিরে রয়েছে ৭১ এর আন্দোলনের দুর্লভ কিছু চিত্র। একটু সামনে এগোলেই ফাঁসির মঞ্চ। সেই মঞ্চকে ঘিরে রয়েছে ৮টি কনডেম সেল। যার বিশেষত্ব হলো, সেলের জানালাগুলোতে লাল রঙ করা। তবে সংস্কারের কারণে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি ফাঁসির মঞ্চ।  

তবে পুরো কারাগার ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে ‘সব খ্যাতিই বিপজ্জনক। সুখ্যাতি ঈর্ষা বয়ে আনে, কুখ্যাতি আনে লজ্জা’র মতো বিভিন্ন জ্ঞানী মানুষদের বাণী। যা লেখা থাকতো কারাবন্দিদের জন্য।

ফাঁসির মঞ্চের ঠিক পেছনেই বিদেশিদের জন্য বন্দি কক্ষ। কারাগারের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে রয়েছে চার নেতার স্মৃতি জাদুঘর। যার সামনে মোজাইক পাথরে বড় করে লেখা সেই মহান নেতাদের নাম। ভেতরে রয়েছে তাদের থাকার ছোট চৌকি, চেয়ারসহ ব্যবহারের জিনিসপত্র।  

আলো ছড়াক জাতির পিতা
কারাগারের ঠিক মাঝখানটাই রয়েছে যমুনা-২। জেলখানার কয়েকটি সেলের একটি। ক’দিন আগেও নানা অপরাধে বন্দিদের আমদানি করা হতো বলে সবাই সেই সেলটি চিনতো আমদানি ওয়ার্ড নামে। সময়ের পরিবর্তনে আজ সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে যুদ্ধকালীন আগে-পরে বঙ্গবন্ধুর নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে  নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র। যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে নতুন প্রজন্মের কাছে উন্মোচিত করবে।  

এর ঠিক উত্তর পাশেই বড় লাল দালান। এর নাম মেঘনা। কেউ কোনো অপরাধ করলে সম্ভবত এ দালানের কথাই লোকমুখে শোনা যায় এভাবে, ‘তোমারে লাল দালানের ভাত খাওয়ামু’।

কারাগারের শেষ মাথায় দক্ষিণ-পঞ্চিম কর্নারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর থাকার সেই স্মৃতি বিজড়িত সেল। সেলের গেটে ঢুকতেই আটকে যাবে চোখ। বড় পোস্টারে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীকে লেখা কয়েকটি চিঠি। এর খানিকটা প্রথমেই বর্ণিত। সেলের ভেতরে রয়েছে মূল আকর্ষণ। সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে চায়ের কাপ, কেতলি, হাড়ি-পাতিলসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্যবহৃত আসবাবপত্র।  

হাসনাহেনার সামনেই স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিমূর্তি। এর চারপাশ সাজানো হয়েছে নানারকম আলোকসজ্জায়। সন্ধ্যায় সে আলো দেখলে মনে হবে যেনো শেখ মুজিবের আলোয় আলোকিত  হচ্ছে  চারপাশ। দূর হয়ে যাচ্ছে সব অন্ধকার।  

‘এভাবেই বঙ্গবন্ধু ছড়াক আলো
দূর হয়ে যাক সকল কালো......
আলোর পথের দিশায় উজ্জ্বীবিত হোক কেন্দ্রীয় কারাগার,
এই প্রত্যাশা এখন সবার.......’

ইতিহাস
০৩ নভেম্বর। জেলহত্যা দিবস। যুদ্ধের পর নতুন করে বাংলাদেশ গড়ার পথে যে কয়টি বাধা রয়েছে তার একটি সংঘটিত হয় এই দিনে। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ষড়যন্ত্র করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী জাতীয় চার নেতাকে। দিনটি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায়।  

এই নির্মম ঘটনার ঠিক আগে একই বছরের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তার ঘনিষ্ট এই চার সহকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। ঘটনার পরদিনই ০৪ নভেম্বর তৎকালীন কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তার নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন। গুলি করে নেতাদের হত্যা করা হয়। পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

আত্মজিজ্ঞাসা
মাঝে মাঝে মনে হয়, জাতি হিসেবে আমরা এতোটাই অকৃতজ্ঞ যে, জাতিকে সুন্দর ভবিষ্যত দিতে এতো ত্যাগ-তিতিক্ষা, সে জাতিই কিনা খুন করতে পারি বঙ্গবন্ধু, চার নেতাসহ অন্য নেতাদের- যারা ছিলেন বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। তবে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরের প্রজন্ম হয়ে আজ গর্বিত। গর্বিত এটা ভেবে, জাতির পিতা মরেননি, মরেননি সেই চার নেতা যারা নীতির সঙ্গে কোনোদিন বেইমানি করেননি। তারা অমর।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৬
জেডএফ/এসজেএ/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।