ঢাকা, সোমবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ওরা ঝামেলা পার্টি (ভিডিও)

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৬
ওরা ঝামেলা পার্টি (ভিডিও)

ঢাকা: কারো মাথায় সবজির ঝুড়ি, কারো মাথায় ফুলকপির বস্তা, আবার কারো মাথায় মিষ্টি কুমড়া ভর্তি বস্তা। সুযোগ পেলেই গাড়ির সামনে দিয়ে দিচ্ছেন ভো দৌড়।

খানিকটা যেন গাড়ির সঙ্গে অলিখিত প্রতিযোগিতার মতো। কে কার আগে পার হতে পারে।

এই প্রতিযোগিতার বলি হয়েছেন অনেকে। কিন্তু থেমে থাকেনি, বরং ক্ষেত্র বিশেষে বেড়েছে এই অশুভ প্রতিযোগিতা। প্রায় দেড়’শ গজ  দক্ষিণে আন্ডার পাস, আর দেড়শ গজ উত্তরে রয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। কিন্তু সেদিকে কাউকে যেতে দেখা গেলো না।

বলছিলাম রাজধানীর অন্যতম পাইকারি কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারের এক নম্বর গেটের ভোর রাতের চিত্র। এখানে পথচারী পারাপার হওয়ার কথা নয়। পুলিশ বারবার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কারওয়ান বাজারের এক শ্রেণীর লোকজন বেড়া ছিন্ন করে সচল রেখেছে এই অবৈধ পথটি।

মাথায় আধা বস্তা জলপাই নিয়ে অনেকটা ডিগবাজি দিয়েই রাস্তা পার হন আব্দুল ওয়াহাব। মিরপুর-১২তে পাইওনিয়ার গার্মেন্টের সামনে দোকান রয়েছে তার। কথা উঠতেই বলেন, এভাবে রাস্তা পার হওয়া ঠিক না।  

‘আপনি নিজেই বলছেন ঠিক না তবুও পার হলেন কেন?’ জবাবে আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘সবাই আহে তাই আহি। সঙ্গ দোষ একটা কথা আছে না। ’

ছবি: দীপু মালাকার/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুলির মাথায় বোঝা চাপিয়ে  রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি প্রাইভেট কারের নিচে পড়তে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন আকবর হোসেন। তারও সব্জির দোকান রয়েছে মিরপুরে। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার প্রসঙ্গ তুলতেই বলেন, ওভারব্রিজ দিয়ে পার হতে গেলে বস্তা প্রতি দিতে হয় ৬০ টাকা। আর এদিক দিয়ে পার হলে দিতে হয় মাত্র ৪০ টাকা। খরচ কমাতে এদিক দিয়ে পার হন তারা।

চলতে চলতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে । যে কারণে আর ভয় করে না বলেও জানান তিনি।

চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে ভয়ঙ্কর এই রাস্তা পারাপারের কারণে এখানে এলেই থেমে থেমে পার হয় যানবাহনগুলো। যে কারণে রাজধানীর আর কোথাও এত সকালে যানজট না থাকলেও এখানে প্রত্যুষেই শুরু হয় যানজট নামের দুঃসহ যন্ত্রণা।

অদূরে বাসের জন্য নির্ধারিত স্ট্যান্ড থাকলেও এখানে এসে যাত্রীদের জন্য দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বাসগুলো। যাত্রী টানার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে অশুভ প্রতিযোগিতা। পেছনের বাসকে ঠেস দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পড়ছে বাসগুলো।   এ কারণে যানজট কখনও কারওয়ান বাজার মোড় পেরিয়ে বাংলামোটর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।

যাত্রী টানার এই অসম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই সরকারি গাড়িও। এমনকি হাসপাতালের নিজস্ব পরিবহনও সামিল এই প্রতিযোগিতায়।   বৃস্পতিবার (৩ নভেম্বর) সকাল ৭ টায় দেখা গেল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বাসকে (ঢাকা মেট্রো চ-০৮-০০২৪)। বেশ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে যাত্রী ও মালামাল বোঝাই করে ফার্মগেট অভিমুখে রওয়ানা দিলো বাসটি।

এই বাসটির সঙ্গে ঠোকাঠুকি লেগে যায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি বাসের। মিনিট খানেকের মাথায় রাজউকের বাসটিকে পথ আগলে দাঁড়ায় বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাস। বিআরটিসির বাসের সামনে পথ রোধ করে আড়াআড়ি ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে ইটিসি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির একটি বাস।

এভাবে চলতে থাকে কে কাকে টেক্কা দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। এই ঠোকাঠুকির যাত্রায় সামিল হয় বারডেম হাসপাতালের একটি বাসও।   কল্যাণপুর অভিমুখী বাসটি (ঢাকা মেট্রো ব ১৪-০৪৬২) সকাল ৭.৪০ মিনিটে এখানে এসে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলতে থাকেন। এ সময় কল্যাণপুর, কল্যাণপুর করে হাঁকও ছাড়েন বেশ কয়েকবার।
বারডেমের বাসটিকে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় বেস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস এর একটি বাস। যথারীতি এই বাসটিও বেশ কিছুক্ষণ তার মতো করে যাত্রী নিয়ে রওনা দেন গন্তব্যে। ততক্ষণে কারওয়ান বাজার মোড় পেরিয়ে বাংলামোটর গিয়ে ঠেকে যানজট। এই যখন অবস্থা তখন এসে হাজির হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহৃত বিআরটিসির দ্বিতল বাস তরঙ্গ (ঢাকা মেট্রো ব ১১-৬১৮০)। এই বাসটিও এসে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে শ্যামলী-কল্যাণপুর ডেকে ডেকে যাত্রী তুলে রওয়ানা দেয়।

এর বাইরে ঢাকা পরিবহন লিমিটেড (গাজীপুর-গুলিস্তান), গাবতলী মিনিবাস মালিক সমিতির ৮ নম্বর বাস, মিরপুর-গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী খাজাবাবা পরিবহন, তানজীল পরিবহন, নিউ ভিশনকে দেখা গেছে তাদের খেয়ালখুশি মতো চলতে। কখনও কখনও যাত্রীদের পক্ষ থেকে মৃদু প্রতিবাদ উঠলেও তাতে কোন কাজ হয়েছে বলে অনুমিত হয়নি।
কারওয়ান বাজার সিগন্যাল মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা দূরত্ব। সেখানে ট্রাফিক পুলিশকে দেখা গেলেও তারা কেউই এগিয়ে এলেন না এই অশুভ প্রতিযোগিতা ঠেকাতে। সকাল ৭.৫০ মিনিটে হাজির হন ট্রাফিক সার্জেট আব্দুল লতিফ। এসে বাইকটি ফুটপাতের উপর পার্ক করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পড়েন।

তার সামনেই চলতে থাকে এই অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার ও যাত্রী তোলা। কিন্তু কোন ভূমিকা রাখতে দেখা গেলো না তাকে।   অবৈধভাবে রাস্তাপার প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলতেই বলেন, এখানে পারাপার হওয়ার কথা না। এটা পুরোপুরি অবৈধ। তাহলে বন্ধ করে দেওয়া হয় না কেন? জবাবে বলেন, বন্ধ করে দিলেও আবার কেটে রাস্তা বের করে। ওরা ঝামেলা পার্টি। দশটার পর আর পাবেন না।  

পান দোকানি আব্দুর রাজ্জাক বাংলানিউজকে জানান, “সরকার কতবার বন্ধ করে দেয়, কিন্তু পারেনি। খুলে হালায় পাবলিকে। কত মানুষ মরে কিন্তু বন্ধ হয় না। বাসে মারে বাসেই তুলে দে দৌড়”।

প্রত্যুষের এই যানজট নিয়ে প্রশ্ন ছিল ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে। তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এই কাটাটি বন্ধ করে দিলে এখানে আর লোক দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।

দিনের বেলায় নগরীর অসহনীয় যানজট এড়াতে যারা সকালের দিকে রাস্তায় পা বাড়ান। তারা আর রক্ষা পাচ্ছেন না এই দুর্ভোগ থেকে। পুলিশ প্রশাসনের গা ছাড়া ভাব পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৬
এসআই/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।