ঢাকা, সোমবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

জেলহত্যা: হে স্মৃতি আমাদের জাগাতে চাও কেন?

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৬
জেলহত্যা: হে স্মৃতি আমাদের জাগাতে চাও কেন?

পঁচাত্তরের মধ্য আগস্ট থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা হয় নভেম্বরের জেলহত্যা তারই ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম।

সেটি অনুধাবন করেই খুনিরা তাকে সপরিবারে হত্যা করে। হত্যা করে তার নিকটজনদেরও। এতেও তারা নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। তারই জেরে ৩ নভেম্বরের জেলহ্ত্যা। তারা ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখলে মৃত্যু ও বিচার তাদের পিছু ছাড়বে না।
 
সুবিধাবাদীদের অনেকেই সেদিন পর্দার আড়ালে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন। বেশিরভাগই নীরবতা অবলম্বন করেছেন। কাদের সিদ্দিকীর মতো কেউ কেউ সশস্ত্র প্রতিবাদও করেছেন। হত্যাকারীরা তাদের নীল নকশার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েই সেদিন যাদেরকে বন্দুকের নলের কাছে বশ্যতা স্বীকার করাতে পারেনি, তাদেরকে একে একে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে।
 
তাজউদ্দিন ২২ আগস্ট নিজ বাসভবন থেকে গ্রেফতার হন আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম গ্রেফতার হন তার সরকারি বাসভবন থেকে। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ১৭ আগস্ট কারাগারে পাঠানো হয়। কামরুজ্জামান, কোরবান আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ আরো ২০ জনকে ২৩ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় (‘পঁচাত্তরের রক্তক্ষরণ: মেজর রফিকুল ইসলাম অব.’।
 
১৯৭৫ এর ১ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের শাসনক্ষমতায় পদার্র অন্তরালে বেশ কয়েকবার পালাবদল হয়। দেশের আপামর জনগণ রয়ে যায় অন্ধকারে। বেতারের ঘোষণার মাধ্যমে যতোটুকু জানানো হয় ততটুকুই  সার।
 
অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ এক চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রবেশ করে। রোমাঞ্চকর ও নাটকীয়তায় ভরপুর সেসব ঘটনাবলী। প্রতি মুহূর্তে পট পরির্তন ও অনিশ্চয়তা।   
 
বঙ্গবভন তখন যেনো একটি সেনা ছাউনি। মোশতাককে ঘিরে চলছে ক্ষমতার লেনদেন। এরই মাঝে ধুরন্ধর মোশতাক নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগারে বন্দি চার নেতাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। কারণ, ২ তারিখ দিনগত রাতে মোসলেম উদ্দিন নাজিমুদ্দিন রোডে অস্ত্র নিয়ে হাজির। এটি কি শুধু মোশতাকেরই একান্ত পরিকল্পনা, না ১৫ আগস্টের খুনিরাও তা জানতো তা নিশ্চিত করা বলা যায় না। কিন্তু চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে মোশতাক ও খুনিরা উভয়েই বেনিফিসিয়ারি হয়েছে। যদিও খুনিরা দেশে থেকে পলায়নের জন্য ইতিমধ্যেই দেনদরবার শুরু করে দিয়েছে। মোশতাক তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। খুনিরা আঁচ করতে পেরেছিল, যেভাবে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে তাতে যেকোনো সময় পাল্টা অভ্যুত্থানে তারা বন্দুকের শিকার হতে পারে।
 
২ তারিখ গভীর রাতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল গাড়ি করে সেন্ট্রাল জেলের ভেতরে ঢোকে। তারা ভেতরে ঢুকে চার নেতাকে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। জেলার আব্দুল আওয়াল তাদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। এ নিয়ে অনেক কথাকাটাকাটি হয়। তারা জোর করে ভেতরে ঢোকে। কারাগারে পাগলাঘন্টা বেজে ওঠে। অবশেষে ডিআইজিকে ঢেকে আনা হলো।
 
ডিআইজিকে মোসলেম উদ্দিন ও তার সহযোগীরা জানালো যে ফারুক ও রশিদ তাদের পাঠিয়েছে। তারা চার নেতাকে তাদের হাতে তুলে দিতে বললো। ডিআইজির সাথে বাকবিতণ্ডা হলো। মোসলেম উদ্দিন তখন বঙ্গভবনে মেজর রশিদকে ফোন দিতে বললো। কিন্ত তার পরও ডিআইজি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সাথে সরাসারি ফোন করে তার নির্দেশ কামনা করেন। মোশতাকও তাকে একই নির্দেশ দেন। প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অমান্য করা ডিআইজির প্রিজনের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
 
তাজউদ্দিন ও নজরুল ইসলাম এক সেলে ছিলেন। পাশের সেলে ছিলেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। তাদেরকে তাজউদ্দিনের সেলে এনে একসাথে হত্যা করা হয়। তিনজন সঙ্গেসঙ্গেই মারা যান। তাজউদ্দিনের পেটে ও হাঁটুতে গুলি লাগে। রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। তিনি একটু পানির জন্য চিৎকার করছিলেন। কিন্তু কেউ পানি দিতে সাহস করেনি। পাশের কামরায় ছিলেন আব্দুস সামাজ আজাদ। তালিকায় নাম না থাকায় প্রাণে বাঁচেন তিনি।
 
৩ তারিখ দুপুরের দিকে পুলিশের আইজি প্রিজন বঙ্গভবনে ফোন করলে জেনারেল খলিল ফোন ধরেন। আইজি তাকে জানান, গত রাতে আর্মির লোকজন জেলে ঢুকে চার আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করে। তিনি চমকে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম চাষীকে সংবাদটি দিয়ে প্রেসিডেন্টকে সংবাদটি দিতে বলেন। চাষী তখনই প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে সংবাদটি দেন। রুম থেকে বেরিয়ে এসে চাষী বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ঘটনাটি জানেন’।
 
কারাগারের ১ নম্বর সেলে পড়ে আছে ৪টি লাশ। ওদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চলছে তোড়জোর। সেখানে অফিসাররা সারাদিন পরিশ্রম করে মেজরদের দেশ ত্যাগের ব্যাপারটি চূড়ান্ত করতে সক্ষম হন। অনেক দেনদরবারের পর তাদের যাওয়ার বিষয়টি বেশ গোপনীয়তার মধ্যেই সম্পন্ন হয়। ওদিকে জেলহত্যার বিষয়টিও গোপন রাখা হয় অনেকের কাছে। জানেন শুধু জেলের সাথে সংশ্লিষ্টরা আর বাইরে শুধু মোশতাক, মোসলেম উদ্দিন, খলিলসহ মাত্র কয়েকজন। খুনিদের নির্বিঘ্ন পলায়ন নিশ্চত করতেই এই গোপনীয়তা।
 
৩ তারিখ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানের একটি প্লেন তেজগাঁও বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছিল। অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ফারুক-রশিদসহ ১৭ জন সদস্য বিমানের যাত্রী। সঙ্গে আছে তাদের স্ত্রী ও পরিবার। মেজর শাহরিয়ারের বান্ধবীও আছে।
 
কেন এ হত্যাকাণ্ড সেটি আজ পরিষ্কার। খোন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ওই চার নেতা। তাই কোনোভাবে ক্ষমতার পালাবদল হলে নিজের পথ পরিস্কার করতেই এ হত্যাকাণ্ড। এক পর্যায়ে খোন্দকার মোশতাকও দেশত্যাগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু খালেদ মোশারফ বাধ সাধলেন।  
 
খুনিচক্রেরও ছিল একই ইচ্ছা। তাজউদ্দিনও সে কথা জানতেন। তাজউদ্দিন জেলে থাকাকালীন দু্বার মিসেস তাজউদ্দিন দেখা করতে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে। শেষবার তিনি মিসেস তাজউদ্দিনকে বলেন, ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমার মনে হয় না যে জীবিত অবস্থায় আমরা কোনোদিন জেল থেকে বের হতে পারবো’। তার ধারণাই সত্য হলো।
 
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খালেদ মোশারফ ও সাফায়াত জামিল যখন জানতে পারেন তখন রশিদ, ফারুক, ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন ব্যাংককে। সেখান থেকে সুবিধামতো গন্তব্যে পাড়ি জমাবেন তারা।
 
একচল্লিশ বছর পার হলো। সেই জেলখানা আজ যাদুঘর। কিন্তু স্মৃতি বুঝি এখনো গুমড়ে কাঁদে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। আমরাও যে সেই অন্তহীন গহীন অন্ধকারেরই যাত্রী। জীবনানন্দের ‘অন্ধকার’ কবিতার একটা লাইন: ‘গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে জাগাতে চাও কেন?-----হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া আমাকে জাগাতে চাও কেন?
 
গ্রন্থসূত্র:
১. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: কর্ণেল (অব) এম. এ. হামিদ
২. বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায়-১৯৭৫-৮১, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন
৩. বাংলাদেশ: এ্য লিগাসি অব ব্লাড: অ্যান্থনি মাসকারেনহাস

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৬
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।