ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

নিশ্চিন্তপুরের ‘বধ্যভূমি’ তাজরীনের ভবন

উর্মি মাহবুব, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৬
নিশ্চিন্তপুরের ‘বধ্যভূমি’ তাজরীনের ভবন

আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকা। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। ঠিক ৪ বছর আগের ঘটনা। তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে-পুড়ে কঙ্কাল...

ঢাকা: আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকা। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর।

ঠিক ৪ বছর আগের ঘটনা। তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে-পুড়ে কঙ্কাল হয়েছিলেন ১১৩ জন পোশাক শ্রমিক।

আজও ভবনটিতে পোড়া দাগ রয়ে গেছে। তবে শ্রমিক হত্যার দায় নিয়ে পরিত্যক্ত সেটি। ২৪ নভেম্বর এলে নিশ্চিন্তপুরের লোকজনও আঁতকে ওঠেন সেই স্মৃতি মনে করে।

নিশ্চিন্তপুরের বাসিন্দা ও আহত শ্রমিকদের কাছে তাজরীন ফ্যাশনের ভবনটি এখন একটি ‘ভয়ঙ্কর বধ্যভূমি’।
 
আহত তিন শতাধিক শ্রমিকের বেশিরভাগই যোগ দিয়েছেন অন্য কোনো কারখানায়। কিন্তু আজও কাজ করতে ভয় পান তারা।

সে রকমই একজন রাবেয়া। রংপুরের এক ছোট্ট গ্রামের মেয়ে। ভাগ্যের পরিবর্তন করতে ২০১২ সালের শুরুর দিকে কাজ শুরু করেছিলেন তাজরীন ফ্যাশনে। ২৪ নভেম্বর মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। চোখের সামনে ঝলসে যেতে দেখেছেন অনেক সহকর্মীকে। পায়ে আঘাত পেয়ে ছয়মাস কাজ করতে না পেরে চলে গিয়েছিলেন মায়ের কাছে। দুই বছর পর পেটের দায়ে ফের আসতে হয়েছে ব্যস্ত নগরীতে। কাজ খুঁজে নিয়েছেন ছোট একটি গার্মেন্টসে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যুভয় তাড়া করে ফেরে রাবেয়াকে।
 
রাবেয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘সেই দিনের কথা ভুলমু ক্যামনে? ওইদিন আমাগো শিপমেন্ট হওয়ার কথা ছিলো। তাই বিকেল ৫টায় ছুটি হওয়ার কথা থাকলেও কারখানা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করতে কইল। প্রথমে যখন অল্প আগুন লাগল, তখন আমরা বের হইতে চাইলে কোয়ালিটি ম্যানেজার আইসা কইছিলো, কিছু হয় নাই। এমনি এলার্ম টেস্ট হইতাছে’।

‘পরে আমরা যখন বুঝতে পারলাম, তখন আমাগো বাইরতো হইতে দেয়ই নাই, বরং গেটে তালা দিয়া দিছিলো। পরে ভাঙা জানলা দিয়া লাফ দিয়া নিচে পড়ি। পা ভাইঙা গেছিলো। এহনও কাজে গেলে মনে হয়, এই বুঝি আগুন লাগল। মাঝরাতে ঘুম ভাইঙা যায় স্বপ্নে আগুন দেইখা। আর ওই বিল্ডিং এর আশেপাশে কোনোদিন যাই নাই। ভয় লাগে’।
 
এমনই অবস্থায় বেঁচে আছেন তাজরীনের আহত কয়েকশ’ শ্রমিক। কিন্তু আজও জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তোবা গ্রুপের মালিক দেলোয়ার হোসেন। তাই ক্ষোভে ফুঁসছেন শ্রমিকপক্ষ। মালিকরা তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের মামলা ধামাচাপা দিতে ষড়যন্ত্র করছেন বলেও অভিযোগ তাদের।
 
স্থানীয় বাসিন্দা রফিক ইসলাম বলেন, ‘এতোগুলো মানুষ এক বিল্ডিংয়ে পুড়ে মারা গিয়েছিলো আমাদেরই চোখের সামনে। নিরুপায় হয়ে আমরা শুধুই দেখেছিলাম। ভবনটি দেখলেই খালি সে রাতের কথা মনে পড়ে’।
 
আওয়াজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে আমাদের শ্রমিকরা নিহত হয়েছেন। কিন্তু মালিকপক্ষ থেকে তাদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়াতো হয়ইনি, বরং বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে চলছে নানা কারসাজি। বায়ারদের পক্ষ থেকে আহত শ্রমিকদের কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিলো বটে, কিন্তু মালিকের পক্ষে থেকে এক টাকাও দেওয়া হয়নি। এতো শ্রমিকের হত্যাকারীর ফাঁসিই আমাদের একমাত্র দাবি’।
 
অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যথার্থ সাক্ষীদের হাজির করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশু। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা শুনতে পাচ্ছি যে, তাজরীন ফ্যাশনের মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তখনকার প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দিতে চাচ্ছেন। সে সময় কারখানায় কর্মরত অনেক শ্রমিকও এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের সাক্ষ্য দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। মামলায় যেন মালিক দেলোয়ার পার পেয়ে যান, সে বিষয়েই ষড়যন্ত্র চলছে’।
 
তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান বাংলানিউজকে বলেন, ‘মামলার শুনানি চলছে। আমরা মামলার বিষয়ে আশাবাদী। আশা করছি, দোষীকে যথার্থ বিচারের মুখোমুখি করতে আমরা অবশ্যই সক্ষম হবো’।
 
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তাজরীন ফ্যাশন পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেদিন কারখানার ২য় তলা থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত এক হাজার শ্রমিক কাজ করছিলেন। কারখানার নিচতলার গুদামে আগুন লেগে তা দ্রুত ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে পুড়ে মারা যান ১১৩ জন শ্রমিক, আহত হন আরও তিন শতাধিক।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৬
ইউএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।