ঢাকা, রবিবার, ২৫ কার্তিক ১৪৩১, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

প্রবাসীদের কান্না থামছেই না!

জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬
প্রবাসীদের কান্না থামছেই না! ছবি: দীপু মালাকার

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নতুন আশা আর জীবন বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে কাতারে গিয়েছিলেন মাদারিপুরের তরুণ রিপন আহমেদ। দিন ফেরানোর আশায় লাখে মাসিক পাঁচ হাজার সুদে মোট তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন তার দিনমজুর বাবা।

ঢাকা: চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নতুন আশা আর জীবন বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে কাতারে গিয়েছিলেন মাদারিপুরের তরুণ রিপন আহমেদ। দিন ফেরানোর আশায় লাখে মাসিক পাঁচ হাজার সুদে মোট তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন তার দিনমজুর বাবা।

তিন মাস না পেরুতেই রিপনের পরিবারের স্বপ্ন গড়াগড়ি খাচ্ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন রিপন। শুধু তাই নয়, চিরদিনের জন্য বৈধভাবে কাতারে কাজ করার যোগ্যতা হারিয়েছেন তিনি।

শনিবার (১৮ ডিসেম্বর) মধ্যরাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে খোলা আকাশের দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথাই হয়তো ভাবছিলেন রিপন।

আলাপ শুরু করলে এক পর্যায়ে রিপন বাংলানিউজকে জানান, মাত্র তিনমাস আগে এই বিমানবন্দরেই পরিবারের সদস্যরা বিদায় জানাতে এসছিলো। অথচ ফেরার কথা কাউকে জানাইনি। কীভাবে জানাবো? শূন্য হাতে ফেরা যে বড় কষ্টের!

মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে কাতারে গিয়ে সেখানে কাজ পাননি তিনি। তাইমাত্র তিন মাসের ভিসার মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এদিকে মেয়াদ শেষ না হতেই রিপনকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটির ইমিগ্রেশন। এই তিন মাসে যে কাজটুকু করেছেন তারও বেতন সঠিক সময়ে পাননি রিপন। ফলে একেবারে শূন্য হাতেই ফিরতে হয়েছে তাকে।

প্রবাস জীবনের কথা বলতে গিয়ে রিপন বলেন, ভোর তিনটায় ঘুম থেকে উঠে টয়লেট-বাথরুমের সিরিয়াল ধরা, পাঁচটায় কোম্পানির গাড়ির জন্য অপেক্ষা, কাজ জুটলে ছয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি। ওভার টাইম থাকলে রাত ১০টা। নইলে বাড়তি আয়ের জন্য গোপনে অন্য কাজ। রাতে ঘরে ফিরে রান্না করে করে খেয়ে ঘুমাতে বাজে রাত ১২-১টা। পরের দিন আবার সেই তিনটায় ওঠা। এটাই প্রতিদিনের রুটিন।

তবে রিপন জানান, রুম ভাড়া দিতে না পেরে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকই বাইরের ফুটপাত, পার্কে রাত কাটিয়ে দেন। না খেয়ে থাকতে হয় তাদের, বলতে বলতে গলা ধরে আসে রিপনের।

শুধু রিপন নয়, তার মতো হাজার হাজার বাংলাদেশি অতিরিক্ত অভিবাসন মূল্যের কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। বিদেশে গিয়ে কম স্বল্প বেতনের চাকরি নিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধও করতে পারছেন না তারা।
ভাগ্যান্বেষণে কাতারে গিয়ে হতাশ রিপনবিদেশে গিয়ে আরও ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছি বলে বাংলানিউজকে জানান শনিবার রাতে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসা এক কর্মী হারাধন দাস। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের এই বাসিন্দা বলেন, কথা ছিল খেয়ে-পরে দেশে অন্তত ৩৫ হাজার টাকা পাঠাতে পারব। সেখানে কোন মাসে ১০ হাজার টাকাই পাঠাতে পারিনি। এদিকে ব্যাংক থেকে চার লাখ টাকার লোনের কিস্তিই পরিশোধ করতে পারছিলাম না। অন্যদিকে নিজের ওয়েল্ডিংয়ের দোকান ছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলতঃ অদক্ষতা ও ভাষা জ্ঞানের অভাবেই বাংলাদেশের শ্রমিকরা কম মজুরি পাচ্ছে, অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।

তবে জনশক্তি কমর্সংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর আওতায় সারা দেশের ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার। তবে সেসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ আছে টাকার বিনিময়ে সনদ দেওয়ারও।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিএমইটি ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে প্রতিবছর গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার ছেলে-মেয়ে নানা ধরনের সনদ নিয়ে বের হচ্ছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কতজন বিদেশে যেতে পারছেন, সেই তথ্য তাদের কাছে নেই। এমনকি দক্ষতাভিত্তিক ডেটাবেজ করে সেখান থেকে বিদেশে লোক পাঠানোর কথা থাকলেও সরকার সেই উদ্যোগ নিতে পারেনি।

এ প্রসঙ্গে কাতার ফেরত অভিবাসী রিপন আহমেদ বলেন, ৩শ’ ২০ টাকার বিনিময়ে তিনদিনের প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু আমি ৬শ’ টাকা দিয়ে একদিনেই সার্টিঠিকেট সংগ্রহ করেছিলাম। স্বল্প সময়ের ওই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কোনো কাজ ভালোভাবে শেখাও কঠিন। তাছাড়া সেখানে সামান্য কয়েকটি বিদেশি শব্দ ও বাক্য ছাড়া আর কিছু শেখায় না।


গন্তব্য দেশগুলোতে প্রবাসীদের সুরক্ষায় বিশেষ কোনো পদক্ষেপও নিতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে শুধু কাতার বা সিঙ্গাপুর নয়, অধিকাংশ দেশেই বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ভালো নেই বাংলাদেশের শ্রমিকরা। প্রবাসীদের কল্যাণে আলাদা মন্ত্রণালয় থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীদের সুরক্ষায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

যদিও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী সংস্থাটির এ প্রতিবেদনকে প্রতিযোগী দেশের অপপ্রচার বলে দাবি করেছেন। প্রবাসীদের সুরক্ষা প্রসঙ্গে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নানাভাবে প্রবাসীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করছি। আমাদের প্রবাসীরা অত্যন্ত ভালো আছে। তবে আমাদের কিছু প্রতিযোগী দেশ বাংলাদেশি নির্যাতনের দু’একটি ঘটনাকে বড় করে তুলছে।

এ প্রসঙ্গে অভিবাসন বিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়্যারবির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আগের চেয়ে এখন বিশ্বের অনেক দেশে শ্রমিক পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে দক্ষ কর্মী যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে দক্ষ কর্মী তৈরি বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে রোববার আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস। প্রতিবারের মতো এবারও দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী।

গত এক দশকের মধ্যে এবছর সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬
জেপি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।