মাওয়া-জাজিরা ঘুরে এসে: দূর থেকে প্রথম যখন কাঠামোটি চোখে পড়ে তখনই বিস্ময়। এইতো পদ্মাসেতু।
এমনইতো একটি কাঠামো হওয়ার কথা। তাহলে কি সেতু কাঠামো পেতে শুরু করেছে? নদীর ভেতরে পিলারের ওপর বসেও গেছে সেই কাঠামো! বিস্ময়মাখা চোখে সামনে এগিয়ে যেতে ভ্রম ভাঙলো, না নদীতে নয় নদীর তীর ঘেঁষে উচু করে বড় বড় কংক্রিটের থামের ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে সোনালী রঙের কাঠামোটি। ওটাই মূল সেতুর স্প্যান।
সুউচ্চ এই কাঠামো। যার নিচের অংশে থাকবে ট্রেন লাইন। উপরে কংক্রিটের ঢালাই পড়ে তৈরি হবে চার লেনের সড়ক পথ।
এটাই পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো। ইস্পাতে তৈরি, তো ইস্পাত কঠিনতো হবেই। আর সে ইস্পাত যেনো তেনো কিছু নয়। খনি থেকে উত্তোলিত বিশ্বসেরা গলিত ইস্পাত ছাদের মধ্যে জমাট বেঁধে টুকরো টুকরো কিউবগুলো তৈরি হয়ে এসেছে চীন থেকেই।
সেগুলোই অতি সতর্কতায় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত কর্মশালায় পয়েন্টে পয়েন্টে জোরা লাগিয়ে তবেই তৈরি হয়েছে একটি পূর্ণ স্প্যান।
এমন ৪১টি স্প্যান তৈরি হবে। প্রতিটি ১৫০ মিটার লম্বা। সেই হিসাবে ৪১টি স্প্যান একটির পাশে একটি বসে পদ্মা সেতুকে করে তুলবে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ।
প্রকল্প এলাকা তদারকিতে ছিলেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির। কথা হলো তার সাথে। জানালেন, কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে কাজ চললেও একেকটি স্প্যান পদ্মাপাড়ের ওয়ার্কশপে পূর্ণ রূপ দিতে সময় লেগে যাচ্ছে পুরো এক মাস। তবে এই দৈত্যাকায় কর্মকাশালায় একসঙ্গে কাজ চলছে চারটি স্প্যানের। সেই হিসাবে ১০ মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে স্প্যানগুলো তৈরির কাজ। তারপর কেবলই তুলে নিয়ে বসিয়ে দেওয়া।
হুমায়ূন কবির ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলানিউজ টিমকে দেখাচ্ছিলেন সে কর্মশালা। সেখানে ঢুকে দেখা গেলো কাজ চলেছে পুরোদমে। শত শত শ্রমিক সেখানে যে যার কাজে মগ্ন। একেকটি কিউব আলাদা আলাদা কংক্রিট কাঠামোর ওপর আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি হচ্ছে। কোনোওটিতে রঙের প্রথম ছোপ লাগিয়ে শুকানো হচ্ছে। কোনওটিতে কেবলই দেওয়া হচ্ছে রঙের স্প্রে। রঙটা সোনালী। এই সোনালী রঙেই তৈরি হবে পদ্মাসেতুর মূল কাঠামো।
প্রতিটি কিউবের গায়ে নম্বর সিল লাগানো রয়েছে। কোনটির সঙ্গে কোনটি কোন পয়েন্টে জোড়া লাগাতে হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ভুল হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। সার্বক্ষণিক তদারকিতে রয়েছে চীনা প্রকৌশলী। বরাবরের মতোই 'নো ইংলিশ.. নো ইংলিশ' বলে এড়িয়ে গেলেন। তবে সেতু প্রকল্পে প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদেরের দেখা মিললো ওয়ার্কশপের বাইরেই। নিজেই গাড়ি চালিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন প্রকল্প এলাকা। বাংলানিউজ টিম দেখে থামলেন। কথা হলো তার সাথে।
তিনি বললেন, সর্বোচ্চ সতর্কতায় এই সেতুর ইস্পাতের মান নিশ্চিত করা হয়েছে প্রতি কিউবিক মিটার স্ট্রাকচারে গড়ে ৭ হাজার ৮০০ কেজি ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে। সলিড ইস্পাতে তৈরি এই কিউবগুলোই জোড়া লাগিয়ে একেকটি পূর্ণাঙ্গ স্প্যান তৈরি হচ্ছে।
স্প্যানগুলোতে রঙের প্রথম ছোপ লাগানো হয়েছে। সিজনড করার জন্য বাইরে খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। রোদে শুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে এই স্প্যান যখন তার দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে তার পরেই তা বসানো হবে সেতুর কাঠামো হিসেবে। ততদিনে নদীর পেট ফুঁড়ে পানির উপরে মাথা তুলবে সবগুলো পিলার।
এরই মধ্যে পিলারের পাইলিংয়ের কাজ ৬৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে গেছে বলে জানান প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী।
তবে পিলার উঠলেই যে স্প্যান বসিয়ে দেওয়া যাবে তা নয়, টপ সেকশনে কাজ চলবে, মাটি সরানো, ক্যাপ পড়ানো, তার ওপরে বেয়ারিং বসবে তার পরেই স্প্যান যাবে। দুটি করে পিলার প্রস্তুত হলে একটি স্প্যান বসিয়ে দেওয়া হবে।
দেওয়ান কাদের জানান, স্প্যান তৈরির কাজ অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতেই চলছে। একটি বলা যায় পুরোই প্রস্তুত। যে দুটির কাজ ওয়ার্কশপে চলছে তাও এক মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
শীতের মওসুমে কাজ একটু দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, পানির নিচের কাজে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। কখনো বেশি চাপ থাকে। কখনো কমে যায়। এছাড়া ওয়াটার ভেলোসিটি, শিপ ইমপ্যাক্ট এসব বিবেচনায় রেখে কাজ এগুতে হয়। গত বর্ষার মওসুমে কাজ অপেক্ষাকৃত দ্রত গতিতেই এগিয়েছে বলে জানান দেওয়ান কাদের। এছাড়া নদী শাসনের কাজও সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার কারণে কাজের অগ্রগতিতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। নদীশাসনের বাকি কাজ এ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেলে আগামী বছর আর কোনও সমস্যাই থাকবে না বলে জানালেন তিনি।
তাতে নির্ধারিত সময়ের মধে্যই পদ্মাসেতুর কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলেই মনে করছেন এই প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী।
নদীর ভেতরে অদূরেই ভেসে থাকা একটি বড় কাঠামো দেখিয়ে বললেন, ওটি একটি বিশেষায়িত ক্রেন, যাতে করে স্প্যানগুলো পিলারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে ও উপরে বসিয়ে দেওয়া হবে। শ্বেত দৈত্যাকায় এই ক্রেন ৩ হাজার ৬০০ টন ওজন বহনের ক্ষমতা সম্পন্ন। এছাড়াও আরো ১০ শতাংশ বেশি হারে মোট প্রায় ৪০০০ টন বয়ে নিয়ে যেতে পারবে এই ভাসমান ক্রেন। আর প্রতিটি স্প্যানের ওজন তিন হাজার একশ টন। যা অনায়াসেই বহন করতে পারবে এই ক্রেন।
তাহলে, স্প্যান প্রস্তুত হচ্ছে। একটি তৈরি হয়ে গেছে পুরোপুরি, দুটির কাজ প্রায় শেষ, বড় ওয়ার্কশপে একযোগে কাজ চলবে চারটি করে স্প্যান তৈরির। যার জন্য প্রস্তুতকৃত কিউবগুলো চীন থেকে এরই মধ্যে বাংলাদেশের পথে। পাইলিং ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে। জাজিরা পয়েন্টে সেতু নামবে যে নাওডোবা পয়েন্টে সেখানে ২০টি পাইল বসানোর কাজ এগুচ্ছে হুলস্থুল গতিতে। নদী শাসনের কাজ চূড়ান্ত প্রায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, সোনালী স্বপ্নের স্বর্ণরঙা সেতু আর নয় বেশি দূর।
আরও পড়ুন..
** পাথর ভাঙ্গার শব্দে স্বপ্ন বুনন পদ্মায়
** পদ্মাসেতুর ১১ কিমি জাজিরা সংযোগ সড়ক প্রস্তুত
বাংলাদেশ সময় ১০০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
এমএমকে