ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বিজয়ের একদিন পরে মুক্ত হয় ফরিদপুর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৭
বিজয়ের একদিন পরে মুক্ত হয় ফরিদপুর

ফরিদপুর: ১৯৭১ এর ডিসেম্বর। দেশের বিভিন্ন জেলায় তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে দিয়েছিল। এভাবে শত্রুমুক্ত হচ্ছিল দেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের জন্মস্থান ফরিদপুর ছিল ব্যতিক্রম। তখনো নির্যাতন, হামলা, লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে পাক বাহিনী ও তাদের এদেশীয়  দোসররা। 

গোটা বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জন করলেও ফরিদপুর পাকিস্তানি হানাদার নামের রাহুমুক্ত হয় ১ দিন পর। ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে ফরিদপুর পুলিশ লাইনে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

ওইদিন সকালেও পাক মিলিশিয়া ও বিহারীদের সাথে মরণপন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল ফরিদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।  

ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা মো. শামসুদ্দিন মোল্যা ১৭ ডিসেম্বরের যুদ্ধের বর্ণনা তুলে ধরেন এভাবেই:

‘মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. মোকাররম হোসেন ও আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ এবং মুজিব বাহিনীর থানা কমান্ডার নীতি ভূষণ সাহার নেতৃত্বে আমরা ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের লক্ষণদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলাম।  

আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যৌথ কমান্ডের নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা অপারেশন করা। দেশের অনেক জায়গা তখন শত্রুমুক্ত হলেও ফরিদপুর ছিল পাক হানাদারদের দখলে। যৌথ কমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফরিদপুর শহর আক্রমণ করার জন্য আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে ৩০/৪০ জনের একটি দল নিয়ে অম্বিকাপুর ইউনিয়নের ভাষানচরে অবস্থান নেওয়া হয়।  

হাবিলদার আবু তাহের দেওয়ানের নেতৃত্বে ১৪ জনের অপর একটি দলে আমরা চর মাধবদিয়া ইউনিয়নের আব্দুল মোল্লার বাড়িতে অবস্থান নেই।  

আগের দিন ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও ফরিদপুরে থাকা হায়েনারা তখনো আত্মসমর্পণ করেনি।  

১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় আমার নাস্তা করছিলাম, এমন সময় ক্যাম্পে খবর এলো গোয়ালন্দ থেকে বিপুল অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পদ্মার ধরে ফরিদপুরের দিকে এগিয়ে আসছে।  

আমাদের কমান্ডার আবু তাহের দেওয়ান আমাদের দ্রুত পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমরা পদ্মা থেকে উঠে আসা একটা নালার ভিতর অ্যামবুশ করলাম। পাক মিলিশিয়া ও বিহারীদের দলটি সামনে চলে এলো। আমরা গুলি চালালাম। ওরাও পাল্টা গুলি শুরু করে দিল।  

এরই মধ্যে আমাদের কমান্ডার পাশের ফয়েজ ভাইয়ের ক্যাম্পে ও খলিলপুরের যৌথ কমান্ডের ক্যাম্পে খবর পাঠিয়ে দেন। আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে এলএমজি, এসএলআর, রাইফেল, স্টেনগান ও গ্রেনেড। গুলি বিনিময় চলতে থাকার এক পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারি যে, আমরা ওদের গুলির রেঞ্জের ভিতরে এসে পড়েছি। তখন আমরা গুলি করতে করতে পিছু হটতে থাকি।  

এসময় আমাদের সহযোদ্ধা ইউনুস মোল্লার শরীরে গুলি লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী ক্যাম্প থেকে নিতিভূষণ সাহা, খান মাহবুবে খোদা, আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ এবং মেজবাহ উদ্দীন খান মিরোজের নেতৃত্বে এবং শহীদ সালাউদ্দীন বাহিনীর ডা. ইমরান মজুমদার রুনু, আমিনুর রহমান ফরিদ, খলিলসহ ফরিদপুরের প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন।  

অন্যদিকে মানিকগঞ্জ থেকে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে  লঞ্চে করে পদ্মা পার হয়ে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নিতে আসেন।  

ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুল তার টিম থেকে ২টি ট্রাকে করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠান এই যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। বেলা ২টার দিকে শেষ হয় এই যুদ্ধ। প্রায় শতাধীক মিলিশিয়া ও বিহারী মারা যায় এখানে। ‘

কান্নাজড়িত কন্ঠে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলতে থাকেন, ‘ সারাদেশে যুদ্ধ যখন শেষ, ক্ষত বিক্ষত বিভিন্ন চরাঞ্চল জুড়ে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা যখন মহানন্দে আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়েঁ উল্লাস করছে তখনও আমরা লড়ে যাচ্ছিলাম। সেই সময় আমরা সহযোদ্ধা ইউনুস মোল্লার মরদেহ নিয়ে তার বাড়িতে যাই। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে!’

আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাখাওয়াত হোসেন বললেন, ‘এই ১৭ ডিসেম্বরই মুক্তিযোদ্ধা শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরের নেতৃত্বে ৩০/৩৫ জনের মুজিব বাহিনীর একটি টিম বিজয়ের খবর শুনে বোয়ালমারী থেকে ফরিদপুর আসার পথে মাঝকান্দিতে পৌঁছালে কামারখালী থেকে আসা পাক আর্মির দুটি ট্রাকের সামনা সামনি হয়ে যায়।  

মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা কমান্ডারের নির্দেশে পজিশন নিয়ে ফায়ারিং শুরু করলে পাক আর্মির ট্রাক থেকে এক অফিসার হাত উচু করে নেমে এসে আত্মসমর্পণ করে। পরে মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা তাদের আটক করে ফরিদপুর সার্কিট হাউসে নিয়ে আসেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫ নম্বর আসামি ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ফরিদপুর জেলা কমান্ডার নূর মোহাম্মদ ক্যপ্টেন বাবুল পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা বর্ণনা করেন:

 ‘ হেমায়েত বাহিনীকে সাথে নিয়ে গোপালগঞ্জকে মুক্ত করে আমরা ফরিদপুর আক্রমণ করার লক্ষে ভাঙ্গায় এসে অবস্থান নিই। এরই মাঝে খরব আসে ঢাকাতে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। আমরা যুদ্ধে চূড়ান্ত জয়ী হয়েছি। খবর পেয়ে আমি আমার দল নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ফরিদপুরে ঢুকি।  

ফরিদপুরে ঢুকেই আমি পাকিস্তান আর্মির কমান্ডার আরবান খানকে আত্মসমর্পণ করতে বলি। আরবান খান আমার পাঠানো লোকের কাছে জানিয়ে দেয়, সে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। তবে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রাজেন্দ্র প্রসাদ নাথ ফরিদপুরে উপস্থিত হন। আরবান খান রাজেন্দ্র প্রসাদ নাথ ও আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে।  

এভাবেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে বিজয়ের ১ দিন পরে ১৭ ডিসেম্বর এসে ফরিদপুর জেলা শত্রুমুক্ত হয়।  
 
বাংলাদেশ সময়: ০০২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭
আরকেবি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।