একসময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কাকন বিবি’র সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে জুলাই মাসে তাকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকত আলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
এই কাহিনী বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাধন ভদ্র।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম জানান, সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি টেংরাটিলায় সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন। বর্তমান টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ড এরিয়াতে ছিল পাক সেনাদের একটি বড় ঘাঁটি। এ ক্যাম্পে বোমা হামলায় অংশ নেন কাকন বিবি। যুদ্ধে পাক সেনাদের নিহত হওয়ার পাশাপাশি ১৫/১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। মহব্বতপুরের যুদ্ধে তার অকুতোভয় বীরত্বের কথা লোকমুখে শোনা যায় আজও। এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের তিনজন নিহত এবং ১২ জন আহত ও বন্দি হয়।
মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারিশ আলী কাকন বিবি’র মমত্বের কথা বলতে গিয়ে জানান, কান্দিগাঁও যুদ্ধে তার হাতে এক পাক সেনা আহত ও বন্দি হলে সেনাটি ‘মা মা’ বলে কেঁদে তার পা জড়িয়ে ধরে। পাক সেনাদের অমানুষিক নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ালেও এতে কাকন বিবির মাতৃহৃদয় আর্দ্র হয়ে যায়। তিনি ঐ পাকসেনাকে প্রাণ ভিক্ষা দেন।
কাকন বিবির বীরত্ব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাধন ভদ্র বলেন, রসরাই যুদ্ধে তার রণচাতুর্যে ছয়জন পাকসেনা আহত ও বন্দি হয়। বেটিগাঁও-নূরপুর যুদ্ধে শত্রুপক্ষের পাঁচজন সেনা নিহত ও তিনজন আহত হয়। দোয়ারাবাজার যুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতায় পাঁচজন শত্রুসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। টেবলাই যুদ্ধে তিনি পাক-রণচাতুর্যকে ধুলিসাৎ করে দেন। তার আক্রমণ চাতুর্যে পাক বাহিনী বাংকার ছেড়ে কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে যায় মাত্র। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের ১০টি লাশ পাওয়া যায়। এছাড়া পূর্ববাজার যুদ্ধে ‘মুক্তিবেটি’ বলে খ্যাত কাকন বিবির চাতুর্যের কারণে ১১ জন পাকসেনা ভবলীলা ত্যাগ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে নারীর অবদান এতোটা, আজ তিনি পড়ে আছেন প্যারালাইসড হয়ে। বেঁচে আছেন তিনবেলা শুধু দুধ খেয়ে। পরিবারের পক্ষে কখনো কখনো ওষুধ দেয়া হয়। কখনো কখনো দুধ কেনাও হয়ে যায় কষ্টসাধ্য। বীরপ্রতীক উপাধি পেলেও এখনো তার মেলেনি স্বীকৃতি। ঠিক মতো কথাও বলতে পারেন না তিনি। আর মুক্তিযোদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলেই কাঁদতে শুরু করেন চিৎকার করে।
এ ব্যাপারে বাংলানিউজের কথা হয় কাকন বিবি’র মেয়ে সকিনা বিবির সাথে। তিনি দুঃখ করে বলেন, মাকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। যুদ্ধের সময় তো মাকে কাছে পাইনি! মানুষের বাড়ি বাড়ি থেকে বড় হয়েছি। আর এখন কাছে থেকেও না পাওয়ার মতো। বর্তমানে ১০৩ বছর বয়স মায়ের। প্যারালাইসড হয়ে পড়ে আছে। কথাও বলতে পারে না ঠিকমতো। ঢাকায় গিয়ে যদি উন্নত চিকিৎসা করাতে পারতাম, তাহলে হয়তো সে একটু সুস্থ হতো। তার ভীষণ ইচ্ছা, নিজের স্বীকৃতির বাস্তবায়নটা নিজ চোখে দেখে যাওয়ার। জানিনা তা পূরণ হবে কি না!
তিনি বলেন, মা একবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিল। তিনি আবার দেখা করতে চান। তার সমস্যার কথা উনাকে শোনাতে চান। আমি সরকারের কাছে তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানাই, মায়ের স্বীকৃতিটা দ্রুত গেজেট আকারে প্রকাশ করার জন্যে। আমি একা মানুষ কি ভাবে সব কিছু একা দেখভাল করবো? আমি একা মেয়ে মানুষ বাজারে যেতে পারি না। আমার স্বামী আব্দুল মতিন সিলেটে ভ্যান গাড়ি চালতো। তাকে নিয়ে এসেছি আমাদের দেখাশোনা করার জন্য। গ্রামে তেমন কাজ না থাকায় সেও প্রায় বেকার অবস্থায় রয়েছে। ফলে আমরা এখন নিদারুণ অর্থকষ্টে দিনযাপন করছি। তারপরেও মায়ের স্বীকৃতিটা হলে শান্তি পেতাম।
এ ব্যাপারে বাংলানিউজের কথা হয় সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের বর্তমান কমিটির সভাপতি সাবিরুল ইসলামের সাথে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, গেজেটের কাজ মন্ত্রণালয়ের। আমরা সব কিছু পাঠিয়ে দিয়েছি। নিশ্চয়ই কাজ হচ্ছে। খোঁজ নিন, প্রয়োজনে আমরা তাগিদপত্র পাঠাব।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭
এইচএমএস/জেএম