ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে শুধুমাত্র নাজিরারটেক শুটকি মহালে মাছের গুঁড়াসহ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুটকি উৎপাদন করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় দু’শ’ কোটি টাকা।
তবে উদ্বেগের বিষয়, পোকামাকড় থেকে রক্ষা এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এসব শুটকিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু নাজিরারটেক নয়, শীত মৌসুমের শুরু থেকে মহেশখালীর সোনাদীয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদীয়াসহ জেলার উপকূলীয় বিভিন্ন শুটকি মহালে শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। সাগরের বেড়িবাঁধ এবং বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার উপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুটকিতে পরিণত করা হয়।
নাজিরারটেক শুটকি মহালে গিয়ে দেখা যায়, শুটকি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কর্মচাঞ্চল্য। যে যার মতো ব্যস্ত। কথাবলারও ফুসরত নেই কারো। সেখানেই একটি আড়তে শুটকি উৎপাদনের কাজ করছিলেন জান্নাত আরা (৩৫)। জান্নাত জানান, সেই ভোর থেকে কর্মব্যস্ততা শুরু। সূর্য ডোবা পর্যন্ত এভাবে চলবে। পাশের আড়তের সুফিয়া বেগম জানালেন, সারাদিন কাজ শেষে মজুরি পাবো ২শ’ টাকা। তা দিয়েই চলে সংসার। শুধু রওশন নয়, রওশনের মতো প্রায় দশ হাজার নারীসহ প্রায় বিশ হাজার শ্রমিকের আয়-রোজগারের উৎস এই নাজিরারটেক।
শুটকি মহালের ব্যবসায়ী মো. শহিদুল্লাহ জানান, শীত মৌসুম শুরুর আগ থেকে নাজিরারটেক শুটকি মহালেও শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে এ বছর ঘূর্ণিঝড় তিতলির কারণে কিছুদিন বিরূপ আবহাওয়া থাকায় উৎপাদন বন্ধ ছিল। এখন আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, এবছরও রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, পোয়া, টেকচাঁদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যা মাছসহ ২০-২৫ প্রজাতির শুটকি এ মহালে উৎপাদন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্ষাকাল ছাড়া বছরের নয়মাস এখানে শুটকি উৎপাদন চলে। তবে গত কিছুদিন সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় উৎপাদনে একটু ভাটা পড়েছে।
নাজিরারটেক শুটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ জানান, প্রায় একশ’ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এ শুটকি মহালে রয়েছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আড়ৎ। দেশের সবচেয়ে বড় শুটকি মহাল এই নাজিরারটেক। এখানে ব্যবসায়ীও আছেন প্রায় দুই হাজার। এ মহাল থেকে সবমিলে প্রতিদিন প্রায় দুইশ’ টন বিভিন্ন জাতের শুটকি উৎপাদন করা হচ্ছে।
প্রতি মৌসুমে উৎপাদন হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন শুটকি। যার বাজার মূল্য প্রায় দু’শ’ কোটি টাকা। এসব শুটকি উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক।
তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, দেশের বৃহত্তম এ শুটকি মহাল থেকে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেওয়া হলেও শুটকি মহালের ভেতরে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন এখানে আনতে হয় অতিরিক্ত ভাড়ায়। ফলে একদিকে শুটকির উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে শুটকি উৎপাদনেও ব্যবসায়ীরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সোনা মিয়া বলেন, শুধু কক্সবাজারের নয়, উপযুক্ত (লবণাক্ত) আবহাওয়ার কারণে প্রতিবছর চট্টগ্রাম থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাছ শুকানোর জন্য এই মহালে আনা হয়, এবারও আনা হয়েছে। উৎপাদনও খুব ভালো হচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবছরও উৎপাদন ভালো হবে আশা করছি।
জেলা মৎস্য কর্মকতা ড. আবদুল আলিম বাংলানিউজকে বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ করে ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুটকি উৎপাদন করা হয়। শুধু কক্সবাজারে নয়, এখানে উৎপাদিত শুটকি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে মানুষের চাহিদা মেটানো হচ্ছে এবং দেশের মানুষের প্রোটিনের বড় একটি অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুটকি থেকে পূরণ হচ্ছে। এমনকি শুটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
কীটনাশক ব্যবহারের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এ প্রবণতা দিন দিন কমে আসছে। নিরাপদ শুটকি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে কয়েকটি এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় আমরা এরইমধ্যে নজিরারটেকে ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীদের নিয়ে আমরা উদ্বুদ্ধকরণ সভা করে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০১৮
জেডএস