এ পদ্ধতিতে পুষ্টিমানের চাহিদা হিসাব করে প্রতিটি রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্য ৭৪৭ টাকা থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয় প্রতিমাসে। এজন্য প্রতিটি পরিবারকে একটি সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়।
সরেজমিনে লেদা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা সারিবদ্ধভাবে কার্ড সংগ্রহ করছেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এ কার্ড পেয়ে খুশি। এখন আর তাদের খাবার নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হয় না। যখন যেটা প্রয়োজন সেটা কিনতে পারেন। নগদ টাকা পেলে অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটাতে খরচ হয়ে যায়। অনেক সময় প্রয়োজনীয় খাদ্যও ক্রয় করতে পারতেন না রোহিঙ্গারা। এর ফলে তাদের পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার খাদ্য সহায়তা বিতরণ উন্নত করতে এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়, যা গৃহস্থালির তথ্য সংরক্ষণ করে এবং এর মাধ্যমে আশ্রয় শিবিরের অভ্যন্তরে সহজেই খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। রোহিঙ্গাদের এ কার্ড পেতে অবশ্যই বায়োমেট্রিকের আওতায় আসতে হবে। তাহলে তারা এ সুবিধা পাবে। এ কার্ড দিয়ে ই-শপ থেকে ১৯ ধরনের পণ্য ক্রয় করতে পারবে। যেমন, চাল, ডাল, ছোলা, আটা, তেল, লবণ, আলু, চিনি, শুটকি, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ, লেবু, মিষ্টি কুমড়া, শুকনো মরিচ, হলুদ ও মরিচের গুঁড়া প্রভৃতি।
এ বিষয়ে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের সিআইসি কাজী নাজিমুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নিউট্রিশন হিসাব করে প্রতিটি রোহিঙ্গা নাগরিককে এ মাসের জন্য ৭৪৭ টাকার কার্ড দিচ্ছি। নগদ টাকা না দিয়ে কার্ডের মাধ্যমে দেওয়ায় তারা চাহিদা মতো পণ্য ক্রয় করতে পারছেন। তবে নিত্যপণ্যের স্থানীয় দামের ওপর টাকার পরিমাণ কমে বাড়ে। এই কার্ড দিয়ে তারা ই-শপ থেকে ১৯ ধরনের পণ্য ক্রয় করতে পারবে। একই সঙ্গে খাদ্য বণ্টনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাসহ পুষ্টিকর খাদ্যও নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে কিছুটা হলেও দুর্নীতি কমেছে।
ইতোমধ্যে ৬টি স্টেশনে এই কর্মসূচি চালু রয়েছে। এর আওতায় প্রায় ২ লাখ ১৭ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছেন। আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে বাকিদেরও কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা যাবে।
এদিকে এক বছর আগে মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে এলাকায় এক বছর ধরে চাষাবাদ বন্ধ, জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। ধ্বংস হয়েছে পাহাড় ও বনভূমি। নষ্ট হয়েছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, স্থানীয়দের শ্রমবাজার ও এলাকার উন্নয়ন অবকাঠামো। শুধু তাই নয় বেড়েছে বিভিন্ন সংঘাতও। যেসব এনজিও স্থানীয় জনগণের জন্য কাজ করত তারা এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করছে। উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি। ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয়দের জীবন ও জীবিকা আজ হুমকির মুখে। কেবল উখিয়া-টেকনাফের মানুষ নয়; রোহিঙ্গাদের কারণে পুরো কক্সবাজারের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েছে বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য।
জানা গেছে, সরকারি হিসেবে উখিয়া ও টেকনাফে মোট ৩০টি রেজিস্টার্ড ক্যাম্প রয়েছে। মূল সড়ক ধরে উখিয়া থেকে টেকনাফের যাবার সময় চোখে পড়ে বন বিভাগের জমি, সরকারি খাস জমি ও সাধারণ মানুষজনের জায়গায় ও পাহাড়ের গায়ে রোহিঙ্গাদের অসংখ্য খুপরি ঘর। পাহাড়ে কোনো গাছ নেই। শুধু ছোট ছোট ঘরের চালা।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৫ আগস্টের আগে গেজেটভুক্ত ৬৭৫ একর বনভূমিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছিল। নতুন করেও রোহিঙ্গা আসা শুরু হলে স্থানীয় প্রশাসন উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গেজেটভুক্ত বনভূমিতে পাহাড় ও বন কেটে অস্থায়ী বসতি নির্মাণ করে। এ দফায় ৪ হাজার ৩১৮ একর বনভূমিতে রোহিঙ্গা বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এক হাজার ২০০ একর সামাজিক বনায়ন ও দুই হাজার ৩১৮ দশমিক ৬০ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়। এতে সামাজিক বনায়নের সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২১৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকারও বেশি। আর প্রাকৃতিক বনের গাছ, লতাগুল্ম, উলুফুল, বাঁশ, বেত, ওষুধি গাছ ও অনান্য উদ্ভিদের ক্ষতি হয়েছে ১৯৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার বেশি। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা বসতির কারণে বনজ সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ৪১১ কোটি ২৮ লাখ টাকার বেশি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের মাটি ও পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গেছে, মাটির উর্বরতা অনেক কমেছে এবং পানিতে জীবাণুর পরিমাণও বেড়েছে। এসব বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি বিবেচনাধীন আছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নতুন করে ভাবছেন স্থানীয়দের জন্য। রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দকৃত অনুদানের ২৫ শতাংশ স্থানীয়দের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে উখিয়া টেকনাফে প্রায় ৫ লাখ স্থানীয়দের বিপরীতে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা হওয়ায় উদ্বেগ বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৮
জিসিজি/এমজেএফ