রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ব্যাপারে এমনই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেন, বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিলেও রোহিঙ্গারা তাদের আট দফা দাবি মেনে না নিলে মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নয়।
গত ৩০ অক্টোবর ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রাখাইনের বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করা ২ হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রথম দিকে প্রতিদিন ১৫০ জন করে রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাবে। বৃহস্পতিবার (১৫ নভেম্বর) এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার বিরোধিতার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে না চাওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং মানবাধিকার অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ ড. সি আর আববার বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ প্রস্তুত হলেও মিয়ানমার এখনও প্রস্তুত নয়। সেদেশে এখনো গুণগতভাবে কোনো কিছুর পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় প্রত্যাবাসন ঘটানো উচিত হবে না। যদি হয়ও, রোহিঙ্গারা আবার নির্যাতিত হয়ে সেখানে বন্দি থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসবে। এছাড়া রোহিঙ্গারা কেন তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাইছে না সেটা আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশ সে বিষয়গুলো সমাধানের জন্য প্রথম থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তারা শুধু বলছে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু দিন যতো যাচ্ছে ততো আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ ও সমাজের ওপর চাপ বাড়ছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে হলে প্রথমে মিয়ানমারের প্রতিটি ক্ষেত্র যেমন- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, অবকাঠামোগত ও রাষ্ট্রীয় গঠননীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এই খাতে পরিবর্তন করাটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া ইউএনএইচসিআরের সম্মতি ছাড়া প্রত্যাবাসন শুরু করলে বৈশ্বিক অঙ্গনে তা একতরফা হিসেবে বিবেচিত হবে। এজন্য বাংলাদেশকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে। তাই মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও চাপ দিতে হবে। এখানে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে জরুরি প্রত্যাবাসন শুরু করা। কারণ প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার চাপটি সেদেশের সরকারের ওপরেই পড়বে।
তিনি বলেন, এই অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। কিন্তু ইউএনএইচসিআর যেহেতু এই প্রত্যাবাসনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে, সেহেতু মিয়ানমার তাদের কথার নড়চড় করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও তারা যদি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার অব্যাহত রাখে, তাহলে পরবর্তী সময়ে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবো। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মাদ আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া প্রতিবেদন প্রত্যাবাসনের অনুকূলে নয়। আমরা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত। তাদের সঙ্গে কথা বলবো। তারা স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে প্রত্যাবাসন শুরু হবে যেকোনো দিন। ওদিকে মিয়ানমারও প্রস্তুত আছে।
এদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার কারণ দেখিয়ে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো প্রত্যাবাসন স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলেছে, বর্তমানে রাখাইনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। এছাড়া মিয়ানমার সীমান্তের কাছে কক্সবাজারের উঁচিপ্রাং শরণার্থী শিবিরে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ করেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এসময় ‘না, না, আমরা ফেরত যাবো না’ বলে স্লোগান দিতেও দেখা যায় তাদের। অনেকের হাতে প্ল্যাকার্ডে দেখা যায়, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই’, ‘নাগরিকত্ব ছাড়া আমরা কখনোই মিয়ানমারে ফিরে যাবো না’।
টেকনাফের লেদা ২৪ নাম্বার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘তরঙ্গ শিশু প্রশিক্ষণ সেন্টার’র বার্মিজ ভাষার প্রশিক্ষক ইয়াসিন আরাফাত বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাই, কিন্তু সেখানে আমাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। মিয়ানমার সরকার যতোদিন পর্যন্ত আমাদের শর্ত মেনে না নিয়ে আমাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করছে, ততোদিন আমরা যেতে আগ্রহী নই। টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে তাদের অবশ্যই বৈষম্যমূলক নাগরিক আইন বিলুপ্ত করতে হবে। রোহিঙ্গাদেরও মিয়ানমারের অন্যান্য নাগরিকদের মতোই সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের দাবি, প্রত্যাবাসনের আগে তাদের নাগরিকত্ব প্রদান, মিয়ানমারে ফেলে আসা বসতভিটা ও সম্পদ ফেরত, ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না হলে তারা ফিরে যাবে না। তাদের ভাষ্য, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। অনেকেই প্রত্যাবাসন আতঙ্কে ক্যাম্প ছেড়েও পালাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ইউএনএইচসিআরের এক কর্মকর্তা গত মঙ্গলবার (১৩ নভেম্বর) বলেছেন, রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের ফেরার মতো অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এখনো তাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি মিয়ানমার সরকার। সেখানে তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। অন্যদিকে প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে রাজি কি-না ইউএনএইচসিআর পক্ষ থেকে তা যাচাই করার প্রক্রিয়াও শেষ হয়নি।
গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। রক্তাক্ত ওই অভিযানের মুখে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সব মিলিয়ে এখন বাংলাদেশের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে প্রায় সোয়া ১১ লাখ। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই অভিযানকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের তরফ থেকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৮
জিসিজি/এইচএ/