সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আবার শুরু হয় নিজের গৃহস্থালির কর্মযজ্ঞ। রাতের খাবার তৈরি করে সন্তান ও পরিবারের সবাইকে খাওয়ানোর পর শক্ত বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন।
নিজে লেখাপড়া না করলেও শিক্ষার মর্ম বোঝেন। ঘরে ও মাঠে কঠোর পরিশ্রম করলেও দুই মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তার স্বপ্ন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একদিন তার মেয়েরা বড় বড় পদে চাকরি করবে।
কণিকা রানী লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের ডাকাত পাড়ার শশীকান্তের স্ত্রী। প্রতিদিন অন্যের জমিতে ১৭০ টাকা দিনমজুরিতে শ্রম বিক্রি করেন তিনি।
কণিকা রানী জানান, দুই মেয়ে ও বৃদ্ধা মা স্বরসতিকে নিয়ে শশী-কনিকা দম্পতির সংসার। নিজেদের জমি বলতে বাড়ির ভিটাটুকুই। স্বামীর দিনমজুরির টাকায় খাওয়া খরচ মেটানোই যেখানে কষ্টকর সেখানে দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো অসম্ভব। তাই নিজের বাড়ির কাজ শেষ করে কৃষি শ্রমিক হিসেবে অন্যের ক্ষেতে কাজ করতে হয় তাকে। এ আয়ে চলে মেয়েদের লেখাপড়া। তার বড় মেয়ে লতা রানী উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে গত বছর রংপুর কারমাইকেল কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছেন। ছোট মেয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। অনেক ভালো বিয়ের প্রস্তাব এলেও বড় মেয়ের বিয়ে দেননি তিনি। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত মেয়েকে বিয়ে দেবেন না বলেও প্রতিজ্ঞা তার।
কণিকা রানী বলেন, নিজে লেখাপড়া করি নাই বলে মানুষের (অন্যের) জমিতে কামলা (দিনমজুরি) দেই ভাই। মেয়েরা যেন কামলা না দিয়ে বড় পদে চাকরি করে শান্তিতে থাকে এজন্যে মানুষের জমিতে কামলা দেই। গরিব হয়া জন্মেছি, কষ্ট তো করতেই হবে।
কণিকার সঙ্গে ক্ষেতে ধান কাটা শ্রমিকের কাজ করেন তারই প্রতিবেশী উর্মিলা রানী। তিনি জানান, তার দুই মেয়ে এক ছেলে। সবাই স্কুল-কলেজে পড়ছে। সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতেই তারা মাঠে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১৭০ টাকার বিনিময়ে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শ্রম বিক্রি করছেন। তবে পুরুষদের সমান সময় কাজ করলেও মজুরি মিলে অর্ধেক।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পুরুষরা ধানের আঁটি বেঁধে কাঁধে বহন করতে পারলেও আমরা (নারীরা) তা পারি না। সেই কারণেই মজুরি অর্ধেক। এছাড়াও অন্যান্য ভারি বোঝা বহনের কাজও আমরা পারি না।
তাদের দলের অপর শ্রমিক বিধবা নমিতা রানী জানান, তার বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। স্বামী না থাকায় সন্তানদের লেখাপড়া থেকে সংসারের যাবতীয় খরচ মেটাতে দিনমজুরি দিচ্ছেন তিনি।
সকালে রান্না শেষ করে সন্তানদের খাইয়ে স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে নিজের জন্য দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে মাঠে চলে আসেন নারীরা।
কাজের ফাঁকে মাঠেই সবাই গোল হয়ে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নেন। কাজ শেষে মজুরি নিয়ে বাড়ি ফেরেন তারা।
নারী কৃষি শ্রমিক ভারতী রানী জানান, সব জমিতে কাজে যান না তারা। কাছে বাড়ি রয়েছে এমন ক্ষেতে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তারা। কারণ, টয়লেটের প্রয়োজন হলে যাতে সেসব বাড়িতে যাওয়া যায়। নারীদের মাঠে কাজ করাটা এখনও সমাজের লোকজন পুরোপুরি মেনে নেয়নি। তবুও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসারের বাড়তি আয়ের জন্যই তারা মাঠে কাজ করেন।
শুধু কণিকা, নমিতা, ভারতী ও উর্মিলাই নন। সংসার নামক যন্ত্রটাকে সচল রাখতে বাড়তি আয়ের আশায় কিংবা সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে দরিদ্র অনেক নারীরাই এখন ক্ষেতে খামারে শ্রম দিচ্ছেন। আগের মতো এখন গ্রামের নারীরা আর ঘরে বসে অলস সময় পার করেন না। প্রয়োজনের তাগিদে পুরুষের সঙ্গে তারাও মাঠে ঘাটে ক্ষেতে খামারে শ্রম দিচ্ছেন। এভাবে সংসারের উপার্জনকারী গর্বিত সদস্য হিসেবে স্বীকৃতিও পাচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের অর্থনীতিতে।
অর্ধেক মজুরিতে কাজ করায় নারী শ্রমিকদের কদরও বেড়েছে আমন সংগ্রহ ও রবিশস্য উৎপাদন কাজে। প্রায় সব মৌসুমে মাঠে কাজ করছেন লালমনিরহাটের গ্রামীণ ছিন্নমূল পরিবারের নারীরা।
আদিতমারী সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু তাহের বাংলানিউজকে বলেন, পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ভূমিকা রেখেছেন নারীরা। তবে বর্তমান প্রতিযোগিতার এ যুগে গ্রামীণ নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে কাজ করে নিজেদের সঙ্গে দেশের উন্নতিতেও ব্যাপক অবদান রাখছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অভাব নামক দানবকে জাদুঘরে পাঠানো যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৮
এসআই