মুক্তিযুদ্ধের সময় মাদারীপুর জেলার মধ্যে কালকিনি উপজেলাটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কালকিনি উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ।
জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এপ্রিল মাসের শেষের দিকে এসে কালকিনিতে পাকবাহিনীর প্রবেশ ঘটে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে কালকিনির ভুরঘাটা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে পাকবাহিনী। শুরু হয় অত্যাচার। নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক বাহিনী। লুটপাট শুরু করে বাড়িতে বাড়িতে। ভুরঘাটার পাশে একটি লালব্রিজ কাছে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে হত্যা করতো পাকবাহিনী।
বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ মোল্যা বাংলানিউজকে বলেন, শতশত মানুষকে হত্যার ভয়ংকর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই লালবিজ্রে। নিরীহ মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে ব্রিজের উপর থেকে জবাই করে, গুলি করে নিচের পানিতে ফেলে দিতো হানাদাররা।
কালকিনি’র ফাসিয়াতলা গণহত্যা আরেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কার্যালয়ের সাবেক কমান্ডার আব্দুল জলিল, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম, হানিফ হাওলাদার বাংলানিউজকে জানান, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝিতে কালকিনি উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের ফাসিয়াতলা বাজারে পাকবাহিনী ও রাজাকার মিলে গণহত্যা চালায়। রাজাকার ও পাকবাহিনী মিলে একটি দল ফাসিয়াতলা বাজারে আক্রমণ করে। প্রথমে আলশামস ও রাজাকাররা মিলে পালরদী নদীর পার খোলা রেখে স্থলভাগের তিনদিক ঘিরে রাখে। ওই সময় দুটি বড় নৌকা নিয়ে পাকিস্তানি মেজর পায়েন্দা খানের নেতৃত্বে ৫০ জন পাকিসেনা ও রাজাকার-আলবদরের ৩০/৩৫ সদস্য মিলে একযোগে আক্রমণ করে ফাসিয়াতলা বাজারে। বাজারে প্রবেশ করে ব্রাসফায়ার করে হত্যা শুরু করে। পরে দোকানপাট লুট ও বাজারসহ আশেপাশের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় কমপক্ষে ৭০০ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা। ওইদিনটি হাটের দিন ছিল। নৌকায় করে হাটে আসা মানুষদের ধরে ধরে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ফাসিয়াতলা বাজার সংলগ্ন ঘোষপাড়ায় চলে হত্যাযজ্ঞের মহোৎসব। হিন্দু সম্প্রদায়ের যারা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল তাদের ঘরে আটকে রেখে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
উপজেলার সিডিখান, এনায়েতনগর, সমিতিরহাট ছাড়াও পাশের বরিশালের গৌরনদী, মুলাদী উপজেলা ও কালকিনির সীমান্তবর্তী তিনটি স্থানে সম্মুখ যুদ্ধ হয় পাকবাহিনীর সঙ্গে। এ সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুরের কালকিনি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মালেক হাওলাদার বাংলানিউজকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় মাদারীপুরের কালকিনির মানুষ সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়েছে। হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে কালকিনি শত্রুমুক্ত হয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ইতিহাস, কালকিনিবাসীর আত্মত্যাগ বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয় না। বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কালকিনিবাসীর আত্মত্যাগের ইতিহাস জানাতে হবে। হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করতে পারে বর্তমান প্রজন্ম সেই লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি পালন করতে হবে। তৈরি করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৮
এনটি