সেই মানবসন্তানটি যদি ভূমিষ্ঠ হয়ে থাকে একটি বিশেষ ঘটনাপ্রবাহে কিংবা জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে, তবে তার গুরুত্ব অনেক। জঙ্গলে জন্ম নেওয়া তেমনি এক যুবক ‘জংলি হাজরা’।
আশ্রয়ের সন্ধানে নিজ ভূমি ছেড়ে প্রাণপণ ছুটে গিয়ে ভারতে কিছুদিনের শরণার্থী হয়েছিলেন রমলীলা হাজরা। একাত্তরের সেই দুঃসময়ে রমলীলা’র গর্ভ থেকে জঙ্গলেই ভূমিষ্ঠ হন জংলি।
‘চারদিক জুড়ে তখন গুলির শব্দ। মনে মনে ভাবছিলাম এই বুঝি একটা গুলি এসে আমাদের শরীরে ঢুকলো। আতংকে মানুষ দিশেহারা। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। আমরাও ছুটলাম ভারতের কমলপুরের দিকে। ’
কথাগুলো বলছিলেন ভাড়াউড়া চা বাগানের শ্রমিক জংলি হাজরা’র মাসি (খালা) বাসন্তি হাজরা।
তিনি আরো বলেন, ‘একাত্তর সালে আমরা প্রাণভয়ে পালিয়ে ভারতের কমলপুরে যাই। সেখানেই জঙ্গলের মধ্যে আমার এই বোনের ছেলের জন্ম হয়। জঙ্গলে জন্ম হয় বলে নাম রাখা হয় ‘জঙ্গলি রাজ’। রাজ বাদ গিয়ে এখন শুধু জংলি রয়ে গেছে’।
ভারতের কমলপুর শরণার্থী ক্যাম্পের এক হাসপাতালের নাম না জানা এক চিকিৎসক খাতায় জঙ্গলিরাজ নামটি লিখেছিলেন বলে জানান বাসন্তি হাজরা।
স্মৃতিচারণ করে বাসন্তি বলেন, খুব তুলতুলে আর নাদুসনুদুস হয়েছিল জংলি। দেখলেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করতো খুব।
শনিবার (১৫ ডিসেম্বর) সকালে ভাড়াউড়া চা বাগানের রামপাড়া শ্রমিক লাইনে গিয়ে একাত্তরের সন্তান জংলি হাজরাকে পাওয়া যায়নি। তখন তিনি চা বাগানে দৈনিক কাজে বের হয়ে পড়েছিলেন। তারপর অনেক খুঁজে পাওয়া গেল তাকে।
জংলি হাজরার বাবা নকুলা হাজরাকে একাত্তর সালে ভাড়াউড়া চা বাগানের গণহত্যা স্মৃতিস্তম্ভ’র সামনে ৪৭ জন শ্রমিকের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিবাহিত জীবনে দুই মেয়ের বাবা জংলি। বড় মেয়ে শোভার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ের বয়স প্রায় ১০। সে তার খালার বাড়িতে থাকে। জংলির স্ত্রী মারা গেছে সাত/আট বছর আগে।
জংলি বাংলানিউজকে বলেন, একাত্তর সালে আমার বাবাকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে। আমি এ পর্যন্ত কোনো প্রকার সরকারি সাহায্য পাইনি বাবু।
ভাড়াউড়া চা বাগানে দৈনিক ১০২ টাকা মজুরিতে খাটেন জংলি। কর্তব্যকর্ম থেকে বিকেলে ফিরে এসে এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি, বন্ধু-পরিজনদের সঙ্গে আড্ডা তারপর আবার সেই চিরচেনা বিছানায় ক্লান্তির ঘুম। বাবার রক্তাক্ত স্মৃতিকে বড় যত্নে আজো বুকে ধরে রেখেছেন একাত্তরের সন্তান জংলি হাজরা।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৮
বিবিবি/এসআই