এসব তথ্য পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক রওশনারা খাতুন যোগাযোগ করেন সাতক্ষীরা জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরে। তথ্যগুলো নিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের খুঁজতে শুরু করেন কালিগঞ্জ সমাজসেবা অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর শেখ আব্দুর রহমান।
অবশেষে তিনি যোগাযোগ করেন কালিগঞ্জের মৌতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী ও স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তারাই খুঁজে বের করে পরিবারটিকে। আর এর মাধ্যমেই দীর্ঘ ১০ বছর পর মায়ের কোলে ফিরলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি শিশু পরিবারে অবস্থানরত শিরিন আক্তার লিজিমা।
১০ বছর আগে রাজধানী ঢাকা থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো সে। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি শিশু পরিবারে ঠাঁই হয় তার, কেটে যায় ১০টি বছর।
এদিকে, শিশু পরিবারে থাকা লিজিমার আত্মপরিচয় মিলেছে এমন সংবাদের সঠিক নিশ্চয়তা পেতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান ফোন করেন কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। নিশ্চিত হন আসলেই সাতক্ষীরার নাম নেওয়া মেয়েটির তথ্য সঠিক কি-না।
পরে লিজিমার সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয় তার মা ও ভাইদের। তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আর তাতে দীর্ঘ ১০ বছর পর মা-ভাইদের সঙ্গে দেখা হয় লিজিমার।
দশ বছর পর মেয়ে লিজিমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি শিশু পরিবারে দেখতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা। আনন্দের জোয়ার রূপ নেয় কান্নায়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন লিজিমার মা। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ও কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফোনালাপের মাধ্যমে লিজিমাকে তুলে দেওয়া হয় তার পরিবারের কাছে।
আর বুধবার (১৯ ডিসেম্বর) লিজিমা ও তার পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সাতক্ষীরা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কার্যালয়ে। সেখানে লিজিমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের ডিডি দেবাশিস সরদার, এডি হারুনার রশিদ, প্রবেশন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, ইউসিডি কর্মকর্তা শেখ সাহিদুর রহমান ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটর শেখ আব্দুর রহমান রানা।
এ সময় লিজিমার পরিবারের সদস্যরা জানায়, তার হারিয়ে যাওয়ার গল্প। তারা বলেন, ঘটনার সূত্রপাত পড়ালেখা নিয়ে একটু বকাঝকার কারণে। সেসময় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় লিজিমা তার বোনের বাড়িতে ছিলো। দুলাভাই আর বোন তাকে পড়াশোনার জন্য বকাঝকা করে। এতে সে রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি লিজিমার।
লিজিমা জানায়, ২০০৯ সালে বোনের বাসা থেকে ঢাকায় চলে যায় সে। সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক নারী তাকে আশ্রয় দেয়। কিন্তু সেই নারী তার স্বামীর আপত্তির মুখে তাকে রাখতে পারেন নি। তখন লিজিমাকে তুলে দেয় থানা পুলিশের কাছে। সেখান থেকে সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্রে ঠাঁই হয় তার। সেখানে তার কথা হয় সরকারি শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক রওশনারা খাতুনের সঙ্গে। তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে তাকে নিয়ে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি শিশু পরিবারে। সেখানেই ১০ বছর কেটে গেছে তার।
এসময় লিজিমার মা ফজিলা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার মন বলছিল মেয়েকে পাবো। আল্লাহ মেয়েকে মিলাইছে। আমি খুব খুশি। মনে হতো সব সম্পদ নিয়ে যদি কেউ মেয়েকে দিয়ে দিতো, তাহলে খুশি হতাম। আজ আল্লাহ আমার মনোবাসনা পূরণ করেছে। ’
কাঁদতে কাঁদতে লিজিমা বাংলানিউজকে বলে, রওশনারা ম্যাডাম, আব্দুর রহমান রানা ভাইয়াসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ভাবতেও পারিনি পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারবো। আজ আমি অনেক খুশি। মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
লিজিমার ভাই নূর আলম বলেন, প্রায় তিন বছর পর্যন্ত বোনকে খুঁজেছি। মাইকিং, পোস্টারিং, পেপারে বিজ্ঞপ্তি কত কিছু করেছি। এক সময় আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত বোনকে খুঁজে পেয়ে খুবই খুশি। সমাজসেবা অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ। তারাই তাকে এতো দিন মায়ে স্নেহে পালন করেছে।
লিজিমার দুলাভাই শহিদুল ইসলাম (শিশির) বলেন, পড়া নিয়ে লিজিমাকে একটু বকাঝকা করেছিলাম। রাতে বাড়ি এসে দেখি সে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও তাকে পাইনি। পরিবারে সবার কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হতো। যে আমার জন্য নিখোঁজ। আজ নিজেকে অপরাধমুক্ত মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০২০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৮
জেডএস