ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শ্রিংলার সুবাদে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় 

তৌহিদুর রহমান, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৯
শ্রিংলার সুবাদে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়  হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা/ফাইল ফটো

ঢাকা: ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার তিন বছর ঢাকায় অবস্থানকালেই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্ক পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়। তিনি হাইকমিশনারের দায়িত্ব থাকাকালেই দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের উচ্চ সফর হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে দু’দেশের মধ্যে মানুষে মানুষে যোগাযোগ।

পাশাপাশি দু’দেশের মধ্যে বেড়েছে অংশীদারিত্ব, সামরিক সহযোগিতা, কানেকটিভি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্বালানি-বিদ্যুৎ সহযোগিতা, ভিসা সহজীকরণ ইত্যাদি খাতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সহযোগিতা।

ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দেন।

তিন বছর দায়িত্ব পালন শেষে তিনি আগামী সপ্তাহে ঢাকা ত্যাগ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রে হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দিচ্ছেন শ্রিংলা। তবে শ্রিংলার সুবাদেই দু’দেশের সম্পর্ক নতুন  উচ্চতায় পৌঁছেছে। তার আমলেই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক সোনালি যুগে প্রবেশ করেছে। সীমান্ত বাণিজ্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশের নানা অবকাঠামো ও ব্যবসা খাতেও বিনিয়োগ বেড়েছে। দু’দেশের মধ্যে  সম্পর্ক বাড়াতে অবিরল চেষ্টা করেছেন তিনি। একই সঙ্গে দেশের নানা প্রান্তে ভারতীয় অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প দেখভাল করতেও ছুটে বেড়িয়েছেন শ্রিংলা।  

দুই দেশের নেতাদের সফর: 
শ্রিংলার সময়েই দু’দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সফর সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকা সফর করেন। এছাড়াও শ্রিংলার আমলেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে কোনো ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকায় আসেন। একই সঙ্গে ভারতের অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জ্বালানিমন্ত্রী, বাণিজ্য ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী শ্রিংলার আমলে ঢাকায় সফর করেছেন।

তিন বছরে দু’দেশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ১০ বৈঠক, ৬টি ভিডিও কনফারেন্স ও ৫ বার টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। ১৯টি উন্নয়ন প্রকল্প যৌথভাবে উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৯৪৭ সাল থেকে জিইয়ে থাকা দু’দেশের স্থল ও সমুদ্রসীমা মীমাংসা হয়েছে। এই সময়ে দু’দেশের মধ্যে ৯০টি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। আর এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের নেপথ্যে ছিলেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।  

ভিসা সহজীকরণ:  
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে নানা কারণেই ভারতে যান সাধারণ মানুষ। তবে ভিসা পাওয়া নিয়ে অতীতে অনেকের মধ্যেই হতাশা ছিল। বিশেষ করে ই-টোকেন না পাওয়ায় ভিসা পেতে বিড়ম্বনা হতো। তবে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভিসা সমস্যা পুরোপুরি সমাধান করতে পেরেছেন। তিনি ই-টোকেন প্রথা তুলে দিতে সক্ষম হন। যে কারণে ২০১৫ সালে ভিসা দেওয়ার পরিমাণ  ৫ লাখ থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে ১৪ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত হয়েছে।

ঢাকা শহরে এক ছাদের নিচে বড় আকারে যমুনা ফিউচার পার্কে ভিসা সেন্টার উদ্বোধন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ সহজেই এক বছর মাল্টিপল ভিসা পাচ্ছেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, সিনিয়র সিটিজেনরা ৫  বছরের মাল্টিপল ভিসা সুবিধা পাচ্ছেন। ভিসা নিয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে  বেনাপোল, গেদে ও ২৪টি বিমানবন্দর পোর্ট উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সে কারণে অন্য যে কোনো পোর্টের ভিসা থাকলেও এসব পোর্ট দিয়ে ভ্রমণকারীরা ভারতে যেতে পারবেন। এছাড়া সিকিম, লাদাখ, অরুণাচলের মধ্যে সংরক্ষিত এলাকায় অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশিদের ভ্রমণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। নতুন করে আরও ছয় জেলায় খোলা হয়েছে ভিসা আবেদন কেন্দ্র।

উন্নয়ন সহায়তা: 
তিন বছরে বাংলাদেশে উন্নয়ন খাতে ভারতের সহযোগিতা বেড়েছে। এই সহায়তা ২০১৫ সালের তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে এখন ৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। পুরোপুরি ভারত সরকার থেকে অর্থায়ন করা ১৫শ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ব্যবসা-বাণিজ্য: 
দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে ৩১.৫ শতাংশ। এই বাণিজ্য ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৯.৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের রফতানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এই বৃদ্ধির পরিমাণ ১০৬.৪ শতাংশ হারে। বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানির হার বেড়েছে ২৬ দশমিক ৩ শতাংশে। বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ তিন বিলিয়ন ডলার থেকে ১০ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। শ্রিংলা দায়িত্ব নিয়ে আসার পর দু’দেশের মধ্যে  সীমান্ত হাট সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। সে কারণে  আরো ৬টি সীমান্ত হাট চালুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এই ৬টি সীমান্ত হাট চালু হলে মোট সীমান্ত হাটের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০টি।  

কানেকটিভি: 
১৯৬৫ সালের আগে দু’দেশের মধ্যে চারটি রেলপথ আবারো চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি পথ ২০১৯ সালের মধ্যে চালু হবে। আরো তিনটি নতুন রেলপথ দু’দেশের মধ্যে চালুর উদ্যোগ রয়েছে। ঢাকা-মৈত্রী ট্রেনের কাস্টম-ইমিগ্রেশন সেবা ট্রেনে উঠার শুরু ও শেষে আনা হয়েছে। ফলে যাত্রাপথে সীমান্তে যাত্রীদের সময় নষ্ট হচ্ছে না। একই সঙ্গে কলকাতা-খুলনার মধ্যে বন্ধন ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। ঢাকা-শিলংয়ের মধ্যে চালু করা হয়েছে সরাসরি বাস সার্ভিস। কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নৌ জাহাজ চলাচল শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তে ২৪ ঘণ্টা কার্গো সার্ভিস চালু করা হয়েছে।

জ্বালানি সহযোগিতা: 
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইনের আওতায় শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশে জ্বালানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে এলএনজি গ্রিড স্থাপনে সমীক্ষা চলছে।

মুক্তিযোদ্ধা: 
২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছর ১০০ মুক্তিযোদ্ধাকে বিনা খরচে ভারতে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত ২০০০ মুক্তিযোদ্ধাকে ৫ বছরের মাল্টিপাল ভিসা দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে সাড়ে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানকে ১০ কোটি টাকার বৃত্তি দেওয়া হয়েছে।  এই প্রকল্পের আওতায় ২০০৬ সাল থেকে ১৩ হাজার শিক্ষার্থীকে ২৩ কোটি টাকারও বেশি বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। ‘নতুন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বৃত্তি’ ২০১৭ সালে ঘোষণা করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২২ সালের মধ্যে ২১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ৫২ কোটি টাকার বৃত্তি পাবে।  

রোহিঙ্গা ইস্যু
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সহায়তায় এ পর্যন্ত চার দফায় প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী দিয়েছে ভারত। শ্রিংলা নিজেও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। ভূমিকা রেখেছেন রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন অনুধাবন করে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ বিষয়ে।

বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩,  ২০১৯
টিআর/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।