গত ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কায় ৩০৪ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেনসহ ৩ বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর এ ঘটনার তদন্তে গঠিত টাস্কফোর্স তদন্ত শুরু করে।
আটকরা হলেন- ফাতেমা ইয়াসমিন তানিয়া (২৬), আফসানা মিমি (২৩), সালমা সুলতানা (২৬), শেখ মোহাম্মদ বাঁধন ওরফে পারভেজ (২৮) ও রুহুল আমিন ওরফে সায়মন (২৯)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯৭০ পিস ইয়াবা, বেশকিছু বৈদেশিক মুদ্রা ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।
আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, মাদকগুলো পাচারে কয়েকটি রুটের তথ্য আমরা পেয়েছি। এগুলো সাধারণত আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান হয়ে শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান-মালয়েশিয়া হয়ে শ্রীলঙ্কায় যেতো। এছাড়া মালয়েশিয়া থেকে চীন হয়ে শ্রীলঙ্কা রুটের কথাও জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক এ চক্রে একটি বাংলাদেশি গ্রুপ সক্রিয়, যার নেতৃত্বে আরিফ ও রেহানা নামে দুইজনের কথা জানা গেছে। রেহানা মাদকসহ চীনে গ্রেফতার রয়েছেন এবং আরিফ বিদেশে পলাতক রয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মাদকগুলো আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে অন্যান্য দেশ ঘুরে শ্রীলঙ্কা গেলেও রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশিদের এই গ্রুপটি দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা পাচার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাদের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমের বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
আটকদের বিষয়ে র্যাবের মুখপাত্র আরো বলেন, আটক পাঁচজনের মধ্যে চারজনই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে গিয়ে মাদক চালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে তানিয়া নিজ এলাকা শরীয়তপুরে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি অনলাইন বিজনেসের সঙ্গে জড়িত। ২০১৬ সালে রাজধানীর তাজমহল রোডে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কোচিং করার সময় ফারহানা ও রুহুল আমিনের মাধ্যমে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বিদেশে অল্পদিনের ভ্রমণেই লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব এমন প্রলোভনে আন্তর্জাতিক মাদকপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যান তানিয়া।
২০১৬ সালে সে রেহানার সঙ্গে মালয়েশিয়া গিয়ে ১০ দিন এবং সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা গিয়ে ৩-৪ দিন অবস্থান করে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। এরপর ২০১৭ সালে আরিফের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে এরইমধ্যে ২ বার ভারত, ৩ বার চীন এবং ৮-১০ বার মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেছেন।
চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার সময় খালি হাতে যান এবং অন্যদেশে গিয়ে লাগেজসহ মাদক বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন। এছাড়া অন্যরুটে আসা মাদকও তারা সংগ্রহ করে গন্তব্যে বণ্টনের কাজ করতেন। এক্ষেত্রে তারা মাদকের শুধু বাহক হিসেবেই নয়, চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতেন বলেও জানান মুফতি মাহমুদ খান।
তিনি আরো বলেন, আটক মিমি বিভিন্ন জায়গায় ডিজে নাচ ও গান করতেন। একটি বেসরকারি চ্যানেলে কাজ করতে গিয়ে আটক সায়মনের সঙ্গে পরিচয় হয়। এবপর সায়মনের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক মাদকপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শ্রীলঙ্কার যে বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ বাংলাদেশি সূর্যমনিকে আটক করা হয়, সে বাড়িটি মিমির নামে ভাড়া নেওয়া ছিলো। বাসাটি সাধারণত সিন্ডিকেটের সেন্টার হিসেবে কাজ করতো। যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মাদকগুলো স্থানীয় বিস্কুট ও কেকের প্যাকেটে করে সাপ্লাই করা হতো।
মিমি ২০১৭ সালে আরিফের সঙ্গে প্রথম মালয়েশিয়া যান এবং সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা যান। ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো শ্রীলঙ্কা গেলে আরিফ তাকে সূর্যমনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
আটক সালমা সুলতানা ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ শুরু করেন। এ সময় তানিয়ার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং বেশ কয়েকবার ভারত, চীন ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন।
আটক সায়মন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। এই সুবাদে বিভিন্ন মেয়েদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতেন তিনি।
আটক পারভেজ কর্মসূত্রে আরিফের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি ২০১৮ সালে দুইবার শ্রীলঙ্কায় গিয়ে প্রায় একমাস অবস্থান করেন এবং সে সময় মাদকদ্রব্য সংগ্রহ, প্যাকেজিং ও সরবরাহে তিনি জড়িত ছিলেন।
এ চক্রের সঙ্গে জড়িত দেশি-বিদেশি আরো বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তদন্তের অগ্রগতি সাপেক্ষে পরবর্তিতে আরো বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
গত ৩১ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ইতিহাসে মাদকের সবচেয়ে বড় চালানসহ বগুড়ার মোহাম্মদ জামালউদ্দিন ও জয়পুরহাটের দেওয়ান রফিউল ইসলামকে গ্রেফতার করে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর উপকণ্ঠ মাউন্ট লাভিয়ানা এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার এই দুইজনের কাছ থেকে ২৭২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেন জব্দ করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫২ কোটি টাকা।
এর আগে ১৪ ডিসেম্বর একই এলাকা থেকে ৩২ কেজি হেরোইনসহ সূর্যমনি নামের এক বাংলাদেশি নারীকে গ্রেফতার করে দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৯
পিএম/জেডএস