ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কথা বললেন ‘দুখু’, ৭ মাস পর খোঁজ পেলেন স্বজনরা

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৯
কথা বললেন ‘দুখু’, ৭ মাস পর খোঁজ পেলেন স্বজনরা জসীম উদ্দীন ওরফে দুখু এখন ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: দুর্ঘটনাস্থল থেকে এনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোট্রমা সার্জারি বিভাগের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তির পর প্রথমদিকে তিনি বাঁচবেন কি-না, তা নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন চিকিৎসক ও সেবক-সেবিকারা। ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করলে ২৩ দিন পর আইসিইউ থেকে তাকে ওয়ার্ডে আনা হয়। খাবার খাওয়ানো থেকে শুরু করে ব্যায়াম করানোসহ যাবতীয় সব সেবা-শুশ্রূষা করছিলেন নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা। কিন্তু মুখ দিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতেই পারছিলেন না তিনি। 

সেজন্য প্রথমে যে পরিচয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সেই ‘অজ্ঞাতপরিচয়ে’ই চিকিৎসা চলতে থাকে। তবে সেবাকাজের স্বার্থে নার্স-ওয়ার্ডবয়রা তাকে ডাকতে থাকেন ‘দুখু’ নামে।

স্বজনদের হদিস মিলছিলো না বলে দুখুকে কোথাও পাঠানোও যাচ্ছিল না, তাই বাধ্য হয়েই হাসপাতালে রাখছিল কর্তৃপক্ষ। বেশ কয়েক মাস পর একদিন দুখু তার নাম বলেন ‘জসীম’, বলেন তার টাঙ্গাইলের ঠিকানা-পরিচয়ও। কিন্তু সেই পরিচয়-ঠিকানার খোঁজ পাচ্ছিল না কেউ।  

দুখুর এই অসহায়ত্ব নজরে আসে বাংলানিউজের। সেই নাম-পরিচয়-ঠিকানা নিয়ে বাংলানিউজ যোগাযোগ করে টাঙ্গাইলে। মিলে যায় ‘দুখু’র ঠিকানা-পরিচয়। ‘দুখু’ হলেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাটা গ্রামের জসীম উদ্দীন (২৩)। বাংলানিউজের মাধ্যমে খবর পেয়ে জসীমের ভাই জহুরুল ইসলাম স্বজনদের নিয়ে ছুটে আসেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে। সাত মাস আগে নিখোঁজ হওয়া ভাইকে ফিরে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।  

হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের ২ জুলাই সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর জসীমকে এখানে নিয়ে আসা হয়। এক পথচারীর সহযোগিতায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালটিতে ভর্তি করেন। প্রথমে আইসিইউতে সেবা দেওয়ার পর ওয়ার্ডে আনা হয়। কোনো স্বজনের হদিস মিলছিলো না বিধায় তাকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবেই চিকিৎসা দিচ্ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।  

জসীমের দীর্ঘদিনের সেবার বিষয়ে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রাশিদা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রথমদিকে জসীম বাঁচবে কি-না তেমন সন্দেহেও ছিলাম আমরা। এরপর আস্তে আস্তে ও সুস্থ হতে শুরু করে। এখানে আমরা নার্সরা এমনকি হাসপাতালের অন্য রোগীর স্বজনসহ বিভিন্ন সেবা সংগঠনের পক্ষ থেকে চাঁদা তুলে জসীমের খাবারের ব্যবস্থা করতাম। জসীম সব সময় ফল ও গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে চাইতো। আমরা তাকে খাইয়েছিও। হাসপাতালের সমাজ সেবা কার্যক্রম থেকেও সহায়তা করা হয়েছিল। সর্বোপরি আমরাই তার সেবা-শুশ্রূষা থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ করতাম। তার নাম দিয়েছিলাম ‘দুখু’। ‘দুখু’ ২৩ দিন পর ওয়ার্ডে এলে এক মাস ধরে অস্পষ্ট স্বরে বিভিন্ন কথা বলার চেষ্টা করতো। কিন্তু আমরা বুঝতাম না। কিছুদিন আগে সে নাম ও পরিচয় জানানোর পর বাংলানিউজের সহায়তায় তার স্বজনদের খুঁজে পায়। ’

ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর রুম্পা রায় বলেন, ‘আমার এক আত্মীয় নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি থাকায় সেখানে যাই। রাতে পাশের ওয়ার্ডে এক রোগীর চিৎকার শুনে সেদিকে যাই। জানতে পারি প্রায় ৭ মাস ধরে এই রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের সেবায় সুস্থ হতে থাকলেও মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় কথা বলতে পারছিলেন না। ২৭ জানুয়ারি কিছুটা সুস্থ হয়ে তার টাঙ্গাইলের ঠিকানা বলেন। ’

বাংলানিউজের টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা করেসপন্ডেন্ট এস এম শহীদ বলেন, ‘অফিস থেকে জানানোর পর টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাটা গ্রামে নির্দেশিত ঠিকানায় খোঁজ করি। জানতে পারি জসীমের মা ও এক বড় ভাই আছেন। বড় ভাই জহুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জসীমের সাত মাস ধরে নিখোঁজ থাকার বিষয়টি জানান। আরও জানান ২০১৩ সালে এসএসসি পাশের পর বড় ভাইয়ের সঙ্গে গাজীপুরে গার্মেন্টসে কাজ করছিলেন। ’

এর পর জহুরুল ইসলাম স্বজনদের নিয়ে ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে ছুটে আসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘জসীম গাজীপুরে একটি গার্মেন্টসে কাজ করতো। দুর্ঘটনার আগে আমার কাছেই ছিল। ও ঘোরাঘুরি করতো কিছুটা। হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর আমরা ওকে অনেক খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাইনি। এতোদিন পরে বাংলানিউজের মাধ্যমে খোঁজ পেলাম। ’

ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল থেকে চিকিৎসকদের পরামর্শক্রমে জসীমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেছেন জহুরুল। সেখানে কিছুটা সুস্থ হলে সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) নিয়ে যাবেন।  

‘অজ্ঞাতপরিচয়ে’ জসীমের প্রায় ৭ মাসের চিকিৎসা সম্পর্কে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোট্রমা বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুস সালাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘হাসপাতলে এমন অজ্ঞাতপরিচয় রোগী সবসময়ই থাকে। কারণ দুর্ঘটনার শিকার হলে অনেক রোগী সাধারণত এভাবেই আসে। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় চিকিৎসা চালিয়ে যাই এবং রোগীর স্বজনদের খোঁজের জন্য মিডিয়াসহ পুলিশের সহায়তা নেই। এই রোগী (জসীম) সুস্থ হতে হলে তাকে চিকিৎসাসহ পুনর্বাসন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সাভারের সিআরপি সবচেয়ে ভালো হবে। আমরাও সেখানেই রেফার করেছি। ’

জসীমের পুনর্বাসনের জন্য চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়ে জহুরুলকে সিআরপিতেও যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে বাংলানিউজ। এ বিষয়ে সিআরপির চিকিৎসক ও শিক্ষক ডা. জাহিদ হোসাইন বলেন, ‘রোগীর কাগজপত্র দেখেছি। সে অনুসারে রোগীকে সুস্থ করতে হলে তার বর্তমান ক্রাইসিস কাটাতে হবে। মস্তিষ্কে আঘাতের চিকিৎসাটা নিউরোসায়েন্স কিংবা ঢামেকে ভালো হবে। ’

এক্ষেত্রে ঢামেকে ভর্তি জসীমের চিকিৎসার জন্য সমাজের বিত্তবানদের কাছে হাত পেতেছেন বড়ভাই জহুরুল। তিনি বলেন, ‘ওর (জসীম) শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ঘা হয়ে গেছে। সেটা শুকাচ্ছে না। হাত-পাও নাড়াতে পারে না। আর আমিও একজন গার্মেন্টস কর্মী। ওর এই চিকিৎসার ব্যয় বহন করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য আমি সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। ’

(জসীমকে পুনর্বাসনের জন্য কেউ সাহায্য করতে চাইলে তার ভাই জহুরুল ইসলামের নম্বর ০১৭৭১৫৩০৮২৫-এ যোগাযোগ করতে পারেন)

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৮
এমএএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।