ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সন্দেহের বশে লঞ্চে ৪ নিরীহ যাত্রীকে নির্দয় গণপিটুনি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৯
সন্দেহের বশে লঞ্চে ৪ নিরীহ যাত্রীকে নির্দয় গণপিটুনি ফাইল ফটো

ঢাকা: শুধু সন্দেহের বশেই লঞ্চে নির্দয় গণপিটুনির শিকার হয়েছেন চার নিরীহ যাত্রী। লঞ্চ মাস্টারসহ কয়েকজন তরুণের সাহসী পদক্ষেপে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে গেছেন তারা। পরে সন্দেহভাজন চারজনই নির্দোষ প্রমাণিত হন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন বাংলানিউজকে জানান, বুধবার (২৭ নভেম্বর) দিনগত রাত আনুমানিক ৩টার দিকের ঘটনা। রাত সোয়া ১২টার পর চাঁদপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা লঞ্চ ময়ূর-৭ মুন্সিগঞ্জ অতিক্রম করছে।

লঞ্চের ভেতরে সুনশান নীরবতা, বেশির ভাগ যাত্রীই ঘুমাচ্ছিলেন।  

হঠাৎ নিচতলার ডেকে থাকা এক নারীর চিৎকার, ‘ব্যাগ নিয়ে গেলো, ব্যাগ নিয়ে গেলো…। ’  চিৎকার শুনে যাত্রীদের অনেকে এগিয়ে গেলেও কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিনতাইকারী মুহূর্তেই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

ছিনতাইকারীর সঙ্গে তার চক্রের আরও লোক লঞ্চে থাকতে পারে এই ধারণা থেকে ব্যাগ হারানো নারী তিন তরুণকে সন্দেহ করেন ও তাদের নিজের আশপাশে কয়েকবার দেখেছেন দাবি করেন।

সন্দেহভাজন তরুণরা নিজেদের নিরপরাধ দাবি করেন ও তা যাচাই করতে বারবার সবার প্রতি অনুরোধ জানান। কিন্তু তাদের কথায় কান না দিয়ে দফায় দফায় মারধর করা হয়।

জানা যায়, তিন তরুণের একজন নির্মাণ শ্রমিক আলম। তিনি তার সহকর্মী সজলকে ফোন করে আসতে বলেন। ফোন পেয়েই ঘুম থেকে উঠে তড়িৎগতিতে ছুটে আসেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। সজলকেও বেধড়ক মারধর করা হয়।

লঞ্চের নিচতলায় আধা ঘণ্টার মতো কথিত জিজ্ঞাসাবাদ ও মারধরের পর সন্দেহভাজন ওই চার তরুণকে নিয়ে যাওয়া হয় লঞ্চের তিনতলায়। সেখানেও দফায় দফায় মারধর করা হয় তাদের।

এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি খেয়ে চারজনের একজন যখন ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন তখন নাটক করছে মন্তব্য করে আরও পেটাতে শুরু করে পাষণ্ডরা।

সেসময় রুবেল, সাজিদ, মাহমুদ, লঞ্চের মাস্টার এমকে লিটনসহ নাম না জানা হাতে গোনা কয়েক তরুণ এভাবে মারধর না করে সন্দেহভাজনদের পুলিশে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু এমন অনুরোধ করায় অতি উৎসাহীদের তোপের মুখে পড়েন তারাও।

লঞ্চে সবাই কম বেশি ঘোরাঘুরি করেন এবং কাউকে আশপাশে দেখা গেছে- শুধু এটুকুর ওপর ভিত্তি করে কাউকে ছিনতাইকারী বলা যায় না মন্তব্য করে মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি বারবার বলছিলাম, প্লিজ মারধর করবেন না। ওদের পুলিশে দেন, পুলিশ তদন্ত করে সত্য-মিথ্যা দেখুক। তাছাড়া এত হালকা সন্দেহে কাউকে দোষী বলা যায় না। কিন্তু তারা থামতে চাচ্ছিল না।

তিনি বলেন, অতি উৎসাহীদের একজন তো আমাকেই ছিনতাইকারীদের গ্রুপের মন্তব্য করে বলছিল ওদের মারলে আমি কেন কথা বলছি। এ নিয়ে ওই লোকের সঙ্গে আমার কলার ধরাধরিও হয়। তখন আমি বলছিলাম, আপনারা তো সেসব লোকদের মতো যারা রাজধানীর রামপুরায় ছেলেধরা সন্দেহে এক মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। আগে সত্য-মিথ্যা যাচাই করুন, প্রয়োজনে পুলিশে দেন।

মাহমুদ বলেন, এভাবে বেশ কিছুক্ষণ যুক্তিতর্ক, ঠেলাঠেলির পর আরও কয়েকজন অভিযুক্ত তরুণদের মারধর না করাসহ বক্তব্য যাচাই করে তাদের পুলিশে দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। এক্ষেত্রে লঞ্চের মাস্টার এমকে লিটনও শক্ত ভূমিকা রেখেছেন।

এর মধ্যে লঞ্চ সদরঘাটে এসে পৌঁছায়। মারধরের শিকার তরুণদের বক্তব্য যাচাই শুরু হয়। যাচাইয়ে চারজন তরুণের কেউই ছিনতাইকারী চক্র বা এর সঙ্গে জড়িত নয় প্রমাণিত হয়।

ভুক্তভোগী চার তরুণের মধ্যে একজন লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ, সোনাপুরের হাসান। তিনি চিৎকার শুনে এগিয়ে যান ও ব্যাগ হারানোর নারীর মেয়ের কাছে কী হয়েছে জানতে চান। এরপর তিনিও চোর ধরার জন্য ছুটে যান। হাসান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

নির্মাণকর্মী সজলের বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচর ও তার সহকর্মী আলমের বাড়ি শরিয়তপুর। সজল তার বাবা-চাচাসহ সিলেটে কাজ করেন। সজলের বাবা-চাচা হাইমচর থেকে এবং সজল তাদের সঙ্গে নতুন কাজে যোগ দেওয়া আলমকে নিয়ে চাঁদপুর ঘাট থেকে লঞ্চে আলাদাভাবে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। সজলের বাবা-চাচা ও সজল আলাদা লঞ্চে প্রায় কাছাকাছি সময়ে সদরঘাট পৌঁছান।

আরেক ভুক্তভোগী তুহিন। লঞ্চ মাঝনদীতে আসার পর শীত লাগায় তিনি রুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে লঞ্চে অবস্থান করছিলেন। ওইভাবে নাক-মুখ ঢাকা অবস্থায় দেখে তাকে সন্দেহ করা হয়। তুহিনও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

হাসান বলেন, ওদের বারবার বলেছি, আপনাদের অভিযোগ সঠিক নয়। ভালোভাবে যাচাই করে দেখুন, আমি নির্দোষ। আমি ছিনতাইকারী তো দূরের কথা, বাকি তিনজনকে চিনিও না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবাই হুজুগে।

সজল বলেন, আমি ঘুমিয়েছিলাম। আলমের ফোন পেয়ে উঠে আসি। ওরা (মারধরকারী) আমার কোনো কথাই শুনছিল না, শুধু বলছিল স্বীকার করে নে তোরা এর সঙ্গে জড়িত, ব্যাগ কোথায় বল। আর সমানে মারছিল।

মারধরকারীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া যাত্রীদের ধন্যবাদ জানিয়ে সজল বলেন, আজ হয়তো মারাই যেতাম। মানুষ অভিযোগ করার আগে কেন যাচাই করে না? কীভাবে নির্দয় হয়ে একজন আরেকজনকে এভাবে পেটাতে পারে?

এদিকে চার তরুণ নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর অতি উৎসাহী হয়ে যারা মারধর করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তথ্য যাচাইয়ের মধ্যে যখন একজন একজন করে নির্দোষ প্রমাণ হতে শুরু করে, ধীরে ধীরে তারা সবাই পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য ভুক্তভোগীরাও কোনো মামলা না করেই যে যার গন্তব্যে চলে যান।

এ বিষয়ে ময়ূর-৭ লঞ্চের মাস্টার এমকে লিটন বাংলানিউজকে বলেন, চেষ্টা করেছি যাতে মারধর না করা হয়। ছেলেগুলোকে দেখেই আমার মনে হয়েছে, এরা নির্দোষ। তাছাড়া অপরাধী হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন আছে, পুলিশ আছে।

সুপারভাইজার আবদুস সালাম বাংলানিউজকে বলেন, অতি উৎসাহী হয়ে যারা মারধর করেছে, যখন ওরা দেখছিল এরা নির্দোষ, সবগুলো আগে আগে ভাগছে (পালিয়েছে)।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৯
এমইউএম/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।