এদিকে স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও নিহত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ।
জানা গেছে, ২৯ নভেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমণের মুখে হানাদাররা পিছু হটতে শুরু করে। এসময় তারা রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর পরামর্শে নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের ধরে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। এদিন প্রাণ হারান শাহিদ, ফারুক, অহিদ, মনির, শাহ আলম, রহমতউল্লাহ, শামসুল, আলম, সালামত, খন্দকার, সুফিয়া, আম্বিয়া, খোদেজাসহ ১৩৯ জন নিরীহ মানুষ। পিছু হটার সময় হানাদার বাহিনী পেট্রোল ও গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী পাড় সংলগ্ন বক্তাবলী পরগনার, রাজাপুর ডিগ্রীর চর, মুক্তাকান্দি, গঙ্গানগর, রাম নগর, গোপাল নগর, রাধানগরসহ ২২টি গ্রাম। গত ৪৪ বছর ধরে নিয়মিত বক্তাবলী দিবস পালন করে আসছে নারায়ণগঞ্জবাসী।
২৯ নভেম্বরের ঘটনা প্রসঙ্গে তৎকালীন ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা তমিজউদ্দিন রিজভী জানান, তারা মুজিববাহিনীর অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষ করে বক্তাবলী ও এর আশপাশের গ্রামে অবস্থান নেন। ওই সময় বক্তাবলীতে এক-দেড়শ’ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় এলাকাটিকে নিরাপদ মনে করতেন মুক্তিযোদ্ধারা। বক্তাবলীতে অবস্থান করেই মূলত বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন তারা। ওই এলাকাতে তখন কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত যুগ্ম আহবায়ক মফিজুল ইসলাম, বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর আজহার হোসেন, আবদুর রব, মাহফুজুর রহমান, স ম নুরুল ইসলামসহ অনেকেই থাকতেন বক্তাবলীতে।
ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর ছিল প্রচণ্ড শীত। সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল পুরো এলাকা। নদীবেষ্টিত হওয়ায় কুয়াশাও ছিল অনেক বেশি। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। উভয়পক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ চলাকালে মুন্সিগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ব্যাটালিয়ন বক্তাবলীতে এসে যোগ দিলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। তারা একত্রে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা যুদ্ধ করেন। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা মোক্তারকান্দি কবরস্থানের সামনে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে আগুনে পুড়িয়ে দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমণে হানাদাররা পিছু হটতে শুরু করে। এসময় তারা রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর পরামর্শে তারা ১৩৯ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে ধরে এনে লাইন ধরিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।
স্থানীয়রা জানান, ঘটনার দিন কানাইনগর ছোবহানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ফারুক সরকার ডিক্রিরচর থেকে আলীরটেকের দিকে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন। তাকে ধরে নিতে দেখেন তারই আপন সহোদর শহীদউল্লাহ সরকার। মসজিদে আশ্রয় নেওয়া শহীদউল্লাহ ছোট ভাইকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে নিজেও আটক হন। পরে তাদের গুলি করে হত্যা করে মরদেহ ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয় পাকিস্তানিরা।
সেদিন হানাদারদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া মজিবর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, গ্রাম থেকে যাদের ধরে এনেছে, তাদের অনেককে মেরে কবরস্থানেই ফেলে রাখা হয়েছিল। আমাদের বেঁধে উপুড় করে ফেলে রেখেছিল, এর মধ্যে হঠাৎ পাকিস্তানি কমান্ডারের ওয়্যারলেস বেজে ওঠে। যাদের বেঁধে রাখা হয়েছে সবাইকে মেরে ফেলার নির্দেশ দিতে শুনি। আমাদের নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি উল্টো দিকে দৌঁড়ে পালিয়ে বাঁচি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৯
একে