ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কুষ্টিয়ায় শঙ্কায় মাটির প্রাণ, ফসল উৎপাদনে খরচ দ্বিগুণ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৯
কুষ্টিয়ায় শঙ্কায় মাটির প্রাণ, ফসল উৎপাদনে খরচ দ্বিগুণ

কুষ্টিয়া: একদিকে জনসংখ্যা বাড়ার ফলে খাদ্যের চাহিদা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। অপরদিকে নগরায়ণ, শিল্প প্রতিষ্ঠান, গৃহ নির্মাণে কমছে আবাদি জমি। খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় কম জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। কম সময়ে ফসল ফলাতে রাসায়নিক সারের দিকে ঝুঁকছেন তারা। ফলে উৎপাদন বেশি হলেও কমে যাচ্ছে ফসলি জমির উর্বর শক্তি। 

বছরের পর বছর এমন চলতে থাকলে এক সময় এসব জমিতে ফসল ফলবে না বলে মনে করছেন মৃত্তিকা গবেষকেরা।

ধান, পাট, অর্থকারী ফসল, সবজি উৎপাদনের দিক থেকে কুষ্টিয়া জেলা দেশের মধ্যে অন্যতম।

এ জেলার মাটি এক সময় যেকোনো ধরনের ফসল চাষে খুবই উপযোগী ছিল। কিন্তু অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার, কীটনাশক প্রয়োগে মাটি দূষণ ও অধিকহারে তামাক চাষের ফলে ধীরে ধীরে মাটিতে কমে যাচ্ছে জৈব পদার্থ।

ফসল উৎপাদনে জৈব সার ব্যবহার না করায় কৃষকদের দ্বিগুণ টাকা খরচ হচ্ছে। অন্যদিকে জৈব পদার্থের অভাবে মাটির অনুজীবগুলোর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মাটিতে এ জৈব উপাদানের অভাবে শঙ্কায় পড়েছে মাটির প্রাণ।

মিরপুর উপজেলার শাহাপুর এলাকার ধান চাষি আব্দুল হালিম বাংলানিউজকে বলেন, আগের মতো জমির শক্তি আর নেই। সারের জোরে ধান চাষ করতে হয়। সার দিলে ধান হয়, না দিলে হয় না। ৫-৭ বছর আগে যে জমিতে সার লাগতো ২০ কেজি, এখন সেখানে লাগছে ৪০-৫০ কেজি।

মাটির উর্বরতা কমায় ফসল চাষে সার লাগছে বেশি।  ফলে বাড়ছে খরচ।

এবছর দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক বস্তা ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ২৫ কেজি পটাশ, ৩১০ টাকার আগাছানাশক এবং পোকা দমনের জন্য প্রায় ৪০০ টাকার কীটনাশক দিয়েছি। এত সার আগে লাগতো না। তবে এখন মাটির উর্বর শক্তি কম হওয়ায় সার বেশি লাগছে।

উপজেলার আমলা এলাকার ধানচাষি আমিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, এবছর ৪ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছি। গত মৌসুমে ৬ বিঘা ধান ছিল। সার-মাটি দিয়ে আগের মতো ধান পাওয়া যায় না। আর দামও নেই। যে ধান ওঠে তা সারের দোকানেই শেষ।

তিনি বলেন, আগের তুলনায় সার এখন দ্বিগুণ লাগে। খরচও প্রায় দ্বিগুণ। তা নাহলে আবাদ হচ্ছে না।

আমিরুল ইসলাম তার তিন ফসলি জমিতে দু’বার ধান আর একবার তামাক চাষ করেছেন। তিন আরও বলেন, তামাকে ইদানিং লাভের চেয়ে খরচ বেশি। সার দিয়ে দিয়ে আমরা মাটি প্রায় নষ্ট করে ফেলেছি। সারের জোরে তামাক করি।

আশাননগর এলাকার সবজিচাষি মারুফ ফুলকপি, বেগুন, আলু, কলা, কুমড়া, লাউ, মুলা, মরিচ, পেঁয়াজ প্রায় সব ধরনের সবজির আবাদ করেন।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মাটির শক্তি দিন দিনকে কমে যাচ্ছে। আমরা কৃষকরা মাটিতে গোবর সারও ঠিকমতো দিতে পারিনি। তাই এখন ২০ কেজির পরেবর্তে ৩০ কেজি সার লাগে। রাসায়নিক সার প্রয়োগে সবজির স্বাদ আগের মতো হয় না।

সবজিচাষি সিহাব আলী বলেন, ক্ষেতে আগের চেয়ে সার বেশি লাগে। আর সারের দামও বেশি। তাই উৎপাদন খরচ দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। আবার বাজারে ভেজাল সারও চলে এসেছে।

উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা জমিতে জৈব সার ব্যবহার করতেই চায় না। তারা তাৎক্ষণিক সুবিধা পাওয়ার জন্য অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে। এতে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে।  

মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বর শক্তি বাড়াতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি, সেই জমির উর্বর শক্তিও বেশি।

কুষ্টিয়া মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আফরোজা নাজনীন বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ রয়েছে এক দশমিক ৬১ ভাগ। অথচ আদর্শ মাটিতে এটি থাকা প্রয়োজন ৫ ভাগ।

জরিপ অনুযায়ী, ২০০৩ সালে কুষ্টিয়ার মাটিতে গড় জৈব পদার্থের পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে এক দশমিক ৯৭ শতাংশ, ২০১৮ সালে দুই দশমিক এক শতাংশ। বিগত ১৫ বছরে কমেছে এক দশমিক ১৪ শতাংশ।

দিনকে দিন উর্বরতা কমছে মাটির।

আফরোজা নাজনীন বলেন, জৈব পদার্থের পরিমাণ কমার অন্যতম কারণ অধিক তাপমাত্রা। আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের ফলে অনুজীবের বংশবৃদ্ধি ও কার্যক্রম অত্যাধিক হারে বেড়ে যায়। ফলে জৈব পদার্থ পচে দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়। এছাড়া ফসল বিন্যাস বেশি হওয়ায় জমিতে থাকা জৈব পদার্থ বেশি পরিমাণ ব্যবহার হয়। উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহারে পুষ্টি উপাদান বেশি প্রয়োজন হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, জৈব পদার্থের পরিমাণ কমতে থাকলে ফসল উৎপাদন কমে যাবে। কারণ, জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। এটি মাটির রস ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

কৃষি কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জৈব পদার্থের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝানো এবং কৃষককের মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় জৈব পদার্থ ব্যবহারের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, ফসলের বেড়ে উঠার জন্য যেসব পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন, তার অধিকাংশ উপাদান জৈব পদার্থের মধ্যে থাকে। বার বার ফসল উৎপাদনসহ নানা কারণে মাটি থেকে জৈব পদার্থ কমে যাচ্ছে। কৃষকরা মাটিতে প্রয়োজন মতো পুষ্টিসমৃদ্ধ জৈব সার দিচ্ছে না। এছাড়া তামাকে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। এমন চলতে থাকলে ফসল ফলাতে খরচ অধিক হারে বেড়ে যাবে। আমরা কৃষকদের এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করছি।

কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শ্যামল কুমার বাংলানিউজকে বলেন, অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার ও জৈব সার ব্যবহার না করাই মাটির উর্বর শক্তি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এমন কমতে থাকলে মাটিতে ফসল ফলানো অধিক ব্যয়বহুল হবে।  

‘আমরা কৃষকদের বিভিন্ন কম্পোস্ট সার, জৈব সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছি। যাতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং মানসম্মত ফসল পায়। তা নাহলে আগামীতে জেলার ফসল উৎপাদনে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৯
এমআইএইচ/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।