মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের উৎরাইল গ্রামে তার বাড়ি। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলে-মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে বেড়ান।
১৯৭১ সাল। দশম শ্রেণিতে উঠেছেন তিনি। তবে স্বাভাবিকের চেয়ে বয়সটা ছিল একটু বেশি। ২০ বা ২২ বছর হবে। টগবগে যুবক। শিবচর নন্দকুমার ইনস্টিটিউশনের ছাত্র তিনি। ৭ মার্চের ভাষণে গ্রাম থেকে দল বেঁধে ঢাকায় গিয়েছিলেন। ফিরে এসেছিলেন বুকভরা চেতনা ও দেশকে স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে।
নিজ গ্রামে ফিরে ইয়াকুব আলী মাতুব্বরের নেতৃত্বে শিরুয়াইল ইউনিয়নে সংগ্রাম পরিশোধ গড়ে তোলেন। যুদ্ধের জন্য ট্রেনিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তিনি।
সমবয়সী ও সমভাবাপন্ন মজিবর তালুকদার, আব্দুস সালাম মাতুব্বর, মোশাররফ তালুকদার, ইলিয়াস খানসহ অনেককে নিয়ে মিটিং করেন গ্রামে।
২৫ মার্চের পর থমথমে অবস্থা। গ্রামে গ্রামে চাপা আতঙ্ক। জুনের প্রথম দিকে আব্দুস সালাম মাতুব্বর ও কাজী জাহাঙ্গীরকে সঙ্গী করে গোপনে বাড়ি ছাড়েন তিনি। কুমিল্লার চান্দিনা থানার বলদাবাজার হয়ে ভারতে ঢুকেন। আগরতলায় তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রয় নেন তারা। সেখান থেকে আগরতলা কংগ্রেস ভবনে গিয়ে নাম লিপিবদ্ধ করান। সেখানে ১৫ দিনের মতো অবস্থানের পর ট্রেনিংয়ের ডাক আসে।
৩০ জনের একেকটি গ্রুপ তৈরি করে শুরু হয় অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ।
পর্যায়ক্রমে শেখেন থ্রি নট থ্রি, মার্ক ফোর রাইফেল, এস এল আর রাইফেল, এস এম জি, স্টেনগান আর হ্যান্ড গ্রেনেড ও ফিফটি টু গান গ্রেনেড চালানোর নিয়ম-কানুন। ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ১০ আগস্ট হেডকোয়ার্টার্স মেলাঘর আসেন। মাসের শেষের দিকে কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে ফিরে আসেন বাংলাদেশে।
চলে আসেন ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে বর্তমান মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর ক্যাম্পে। তখন ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন এরিয়া কমান্ডার মোসলেম উদ্দিন খান।
এরপর অংশ নিতে শুরু করেন একের পর এক যুদ্ধে। টগবগে যুবক ওহাব মুন্সী ব্যবহার করতেন স্টেনগান আর গ্রেনেড। তিনটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। প্রথমে শরিয়তপুরের জাজিরা, এরপর রাজৈরের কলাবাড়ী এবং শেষে শিবচর থানা অপারেশন। আহত হন এখানেই। বড় আপেক্ষ নিয়ে যুদ্ধ থেকে বিদায় নিতে হয় তার।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ওহাব মুন্সী বলেন, ২৪ নভেম্বর রাতে শিবচর থানা হানাদারমুক্ত করতে আমরা আক্রমণ করি। ভাঙ্গা, সদরপুর ও শিবচরের আনুমানিক ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ অপারেশনে যোগ দেন। থানার পূর্ব ও উত্তর পাশ থেকে আমরা আক্রমণ করি। এসময় সহযোদ্ধা শিবচরের আব্দুস সালাম, সদরপুরের দেলোয়ার হোসেন ও মোশাররফ হোসেন মারা যান। আমিসহ আহত হন কাজী ফিরোজ অর রশিদ ও হেলাল বেপারী। ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে শিবচর থানা শত্রুমুক্ত হয়। ২৪ নভেম্বর ভোর রাতের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বুলেট আমার মাথার হেলমেট ছিদ্র করে চলে যায়। অপরটি কাঁধ ছিদ্র করে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে প্রাণে বেঁচে রয়েছি।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু চোখে ভাসে। কতো কষ্ট, দুর্দশা ছিল মানুষের। কতো ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
ওহাব মন্সী বলেন, এখনকার ছেলে-মেয়েরা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এসব নিয়ে জানতে চায় না। তারা মোবাইলের গেমস নিয়ে ব্যস্ত। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে তাদের। আমি সুযোগ পেলেই আমার এলাকার শিশু-কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলি। আমার অভিজ্ঞতা বলি। যাতে করে এখনকার প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এদেশের স্বাধীনতা এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে বর্তমান প্রজন্ম যেন বেড়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের যেন স্মরণ করতে পারে এ প্রজন্ম। তাদের প্রতি যেন শ্রদ্ধাবোধ জাগে। এ বোধ থেকেই নিজের গ্রামের স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব মুন্সী।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৯
আরবি/