প্রচণ্ড শীতে নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে ছুটে চলেন কৃষক, ঘরে তার কৃষাণী স্ত্রী ধান সিদ্ধ করার পাশাপাশি হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগলের পরিচর্যাতে ব্যস্ত। সূর্য মামা হয়তো তখন ঘুমিয়ে অথবা ঘন কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে।
এভাবেই শীতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করে শুরু হয় সাখাওয়াত-মোমেনাদের নিত্যদিনের কাজ। প্রচণ্ড ঠান্ডা মাটি অথবা হিমশীতল পানির স্পর্শে কখনো কাতর হন না তারা। এদের কখনো দরকার হয়না হাত-পায়ে মোজা কিংবা শরীরে মোটা সোয়েটারের।
পাখির কলরব আর মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় কৃষাণ বাড়ীর শিশুদেরও। ঘুম থেকে জেগে শীত নিবারণের জন্য ধান সিদ্ধ করার চুলার পাশে দাঁড়িয়ে যায় তারা। চুলার পাশে বাঁশি ভাত-তরকারি নিয়ে খেতে বসে শিশুরা। এরপর কেউ খেলাধুলায় মত্ত হয়ে ওঠে আবার কেউ বই খাতা নিয়ে বসে পড়ে। শিশুদের কলতানে ভরে ওঠে সমগ্র উঠান।
এদিকে, এক প্রহর মাঠের কাজ শেষে কৃষক ফেরে ঘরে। ততক্ষণে কৃষাণীও কাজের ফাঁকে ভাত রান্না করে ফেলেছেন। এবার গরম ভাতের সঙ্গে বাঁশি তরকারি দিয়ে সকালের আহার শেষে আবারও মাঠের দিকে ধেয়ে চলেন কৃষক।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার অজপাড়া গাঁ পশ্চিম মোহনপুর, শিবনাথপুর, জগৎগাঁতী ও কয়েলগাঁতী গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে এমনই কৃষক-কৃষাণীর কর্মব্যস্ত দিনপঞ্জির চিত্র দেখা যায়।
পশ্চিম মোহনপুর গ্রামের সাখাওয়াত আলীর মতো একই গ্রামের সাইফুল ইসলাম, শিবনাথপুরের আব্দুস সাত্তার, বাবর আলী, নজরুল, সোনাউল্লা, আব্দুল মজিদ, মজিবর রহমান, কয়েলগাঁতীর আব্দুল খালেক ও সাইদুল ইসলাম এবং জগৎগাঁতীর রফিকুল ইসলামের বাড়িতেও অভিন্ন চিত্র দেখা যায়।
কৃষকের বাড়িতে সবেমাত্র আমন ধানের মৌসুম শেষ হয়েছে। মাড়াই শেষে এখন সিদ্ধ করার কাজ চলছে। অপরদিকে, পালং শাক, ফুলকপি, মূলা, বেগুনসহ নানা প্রকার সবজিতে ছেয়ে গেছে মাঠ। এ কারণে ফুসরত নেই কৃষক পরিবারের। একদিকে সিদ্ধ করে গোলায় তুলতে হবে ধান, অপরদিকে প্রতিদিনই ক্ষেত থেকে সবজি তুলে বাজারে বিক্রি করতে হবে। আবার কিছু কিছু সবজির পরিচর্যা করা কিংবা বোরো ধানের বীজতলারও খোঁজ-খবর রাখতে হচ্ছে তাদের।
এতো কাজের মধ্যে শীত নিয়ে ভাবার সময় নেই কৃষাণ-কৃষাণীদের। সূর্য উঠলো কি উঠলো না, কুয়াশা ভাঙলো কি ভাঙলো না, তাপমাত্রা কমেছে না বেড়েছে এসব কিছু মাথায় ঢোকানোর অবকাশ নেই তাদের।
২২ শতক জমিতে ফুলকপির আবাদ করেছেন কৃষক সাইদুল। গত দু-তিন মাস ধরে রাতদিন শ্রম দিয়ে প্রতিটি ফুলকপিকে সন্তানের মতো পরিচর্যা করেছেন তিনি। শ্রমের পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। একেকটি ফুলকপি এক থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত ওজনের হয়েছে।
সাইদুল বাংলানিউজকে বলেন, ৭/৮ হাজার টাকা খরচ করে আমি ফুলকপির আবাদ করেছি। ইতোমধ্যে পূঁজি উঠে গেছে। আরও অন্তত ১২/১৫ হাজার টাকার কপি বিক্রি করতে পারবো।
গাঁয়ে শাল চাদর জড়িয়ে দুটি গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছিলেন জগৎগাঁতী গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম। ঘুম থেকে কখন উঠেছেন, কিভাবে দিনের কাজ শুরু করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আন্দার থাইকতে উইঠা ওজু কইর্যা মসজিদে নামাজ পড়ছি। তারপর বাড়িয়ালার (তার স্ত্রী) সঙ্গে ধান সেদ্ধ করার কাম কইর্যা গরু নিয়্যা মাঠে বারাইচি। গরু দুইডা গোছর দিয়্যা আবার ক্ষেতের বেগুন তুইলা পাইকোশা বাজারে নিয়্যা বেইচতে অইবো। ’
শীতকে কোনো প্রশ্রয় দেন না আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, শীতের জন্য ঘরে বইস্যা থাইকলে আরও জাইক্যা বইসপো। কামকাজের ওপর থাকলে শীত কাছেও আইসপ্যার পাইরবো না।
খড়ের পালা গোছাতে গোছাতে কয়েলগাঁতী গ্রামের কৃষাণী জয়গন বলেন, আমাগোরে এ্যাহন কতা কওয়ার টাইম নাই। মেলা কাম পইড়া আছে।
নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় লাগানো মাচা থেকে শিম তুলতে তুলতে কৃষানী হালিমা বললেন, চুলোয় ভাতের হাড়ি দিয়া আসছি। মাচা থেইক্যা কয়ডা শিম আর লাউপাতা তুইল্যা ভর্তা দিমু।
এমন নানা চিত্রই রয়েছে গ্রাম বাংলার প্রতিটি কৃষকের ঘরে ঘরে। আবার ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ছোঁয়াও লেগেছে এসব গ্রামে। পাড়ায়-মহল্লায় হয়েছে পাকা কিংবা অর্ধপাকা সড়ক। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা। আবার মধ্যবিত্ত কৃষকেরা বসবাস করছেন পাকা বাড়িতে।
সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান শেখ বলেন, গাঁয়ের প্রতিটি কৃষকের কর্মদিবস শুরু হয় ভোর ৫টা থেকে। ফসল উৎপাদনের জন্য দিনভর একটার পর একটা কাজ নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকেন। এদের কাছে শীত বা গ্রীষ্ম একই সমান। তবে এখন অনেক সুবিধাই কৃষকের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তাদের উৎপাদিত ফসল কাঁধে করে শহরে বা বাজারে নিতে হয় না। ঘর থেকে বেরুলেই রাস্তা। সাইকেল কিংবা রিকশা-ভ্যানে তারা ফসল বাজারে নিতে পারছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯
এনটি