বগুড়া: বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নের শাঁওইল মধ্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা আফরুজা বেগম। দাঁড়িয়ে আছেন তাঁত মেশিনের চালকের স্থানে।
বোরবার (১৩ ডিসেম্বর) শাঁওইল গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে নারী ও পুরুষ ঠকাস-ঠকাস শব্দে তৈরি করেছেন কম্বল-চাদর।
সরেজমিনে দেখা যায়, ষাটোর্ধ্ব নারী আফরুজা বেগম মেশিনের নিচের অংশ দু’পা দিয়ে পরিচালনা করছে। ওপরে ঝোলানো দাঁড়ির মাথার নিচ প্রান্ত ধরে টানাটানিতে সচল একহাত। আরেক হাত দিয়ে সুতার কাঠি ‘আকু’ (স্থানীয় ভাষায়) মেশিনের এপাশ-ওপাশে করছেন। দিনের সিংহভাগ সময় তাঁত মেশিনে ব্যস্ত থাকেন তিনি। এভাবে একটা সময় পর মেশিন থেকে বেরিয়ে আসছে রং-বেরংয়ের বাহারি ডিজাইনের কম্বল, তোয়ালে, চাদর, গামছাসহ বিভিন্ন ধরনের তাঁতের বস্ত্র।
শীত নিবারণের জন্য দুস্থদের মধ্যে বিতরণের জন্য সরকারিভাবে কেনা কম্বল ও চাদরের সিংহভাগ তৈরি হয় শাঁওইল গ্রামে। শাঁওইলসহ জেলার মোট ৫০টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। এ গ্রামগুলোর বেশির ভাগ মানুষ সারাবছর ধরে শীতের কম্বল ও চাদর তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
বগুড়া শহর থেকে বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়ক ধরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে আদমদীঘি উপজেলা সদর। সদর থেকে ৫-৬ কিলোমিটার উত্তরে নশরৎপুর ইউনিয়নের শাঁওইল গ্রাম। প্রায় ৪২টি গ্রাম নিয়ে এ ইউনিয়ন।
কাকডাকা ভোর থেকে এ গ্রামে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েন হাজারো কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষ। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাদের কর্মযজ্ঞ।
১৯৭৯-৮০ সালে শাঁওইল গ্রামে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তি কম্বল বানানোর তাঁত মেশিন স্থাপন করেন। এরপর থেকে দরিদ্র মানুষগুলো নিজেদের এ পেশার সঙ্গে যুক্ত করতে থাকেন। সময়ের ব্যবধানে গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে এ তাঁত শিল্প। এখানকার তৈরি করা কম্বল, চাদর, গামছা, তোয়ালেসহ নানা ধরনের বস্ত্র দেশের মধ্যে ব্যাপক পরিচিত লাভ করে। ১৯৮০ সালের পর থেকে এ গ্রামে হাট বসতে শুরু করে।
শাঁওইল মধ্যপাড়া এলাকার আফরুজা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, এটি তার জীবিকা নির্বাহের এক মাত্র উৎস। স্বামী-সন্তানসহ মোট সাত সদস্যের সংসার ছিলো তার। চার ছেলে ও এক মেয়ে, তাদেরকে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে বৃহৎ পরিবারে স্বামী, ছেলে ও ছেলের বউসহ সবাই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।
তিনি বলেন, এ কাজে বস্ত্র তৈরিতে আঁচ, রও, নলি, আকু, চরকা, চরকি, লাটাই, সুতা, রংসহ প্রয়োজন হয় বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী। পরিবারের একে-অপরের সহায়তাসহ বিভিন্ন কাজ ভাগাভাগি করে নেন তারা। কেউ লাটাই, চরকি ও ড্রাম ঘুরিয়ে সুতা গোছার কাজ করেন, কেউবা কম্বল-চাদও তৈরির কাজ করেন আবার কেউ সংসারের অন্য দিক সামলান।
তিনি আরও বলেন, অধিক পরিশ্রম করলে দিনে ১০ থেকে ১২টি কম্বল, ১০টি চাদর, ১৫ থেকে ২০টি গামছা তৈরি করা যায়। রকমভেদে প্রতি পিস কম্বল ২৫০ থেকে ৯শ টাকা, চাদর সাড়ে ৩শ থেকে ৭শ টাকা, তোয়ালে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা, গামছা ১২০ থেকে ২৮০ টাকা (এক থান চার পিস) দামে বর্তমানে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে বাজারে।
মতিউর রহমান, সাবিদ আলী, ধীরেন চন্দ্রসহ একাধিক তাঁতি বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকার বিভিন্ন গার্মেন্টেসের অপ্রয়োজনীয় সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় এসব বস্ত্র। সুতা আনার পর বিভিন্নভাবে তা উপযোগী করে তোলা হয় বস্ত্র বানানোর কাজে। এরপর সুতার সঙ্গে অন্যান্য জিনিসের সমন্বয় ঘটিয়ে তৈরি করা হয় কম্বলসহ আকর্ষণীয় সব বস্ত্র।
স্থানীয়রা জানান, কিছু ব্যবসায়ী এ কম্বল ও চাদরগুলো গ্রামে ঘুরে-ঘুরে সংগ্রহ করে। এ কাজে নিয়োজিত কিছু পরিবারের সদস্যরা গ্রাম ঘুরে বাড়ি বাড়ি থেকে কম্বল ও চাদর কেনেন। এসব কেনার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা অগ্রিম টাকা নেন। এর ফলে ওই ব্যবসায়ীদের কাছেই কেনা কম্বল ও চাদর বিক্রি করতে হয়। এ কারণে সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হন এলাকার তাঁত শিল্পীরা।
এদিকে প্রতি বছর শীতে দুস্থদের মধ্যে বিতরণের জন্য সরকারিভাবে কম্বল কেনা হয়। কিন্তু এই কম্বল সরাসরি সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারেন না তাঁতিরা। এতে করে লাভের বেশির অংশ চলে যায় মধ্যসত্বভোগী পাইকারি ব্যবসায়ীদের পকেটে। তাই সরকার যদি দরপত্রের মাধ্যমে সরাসরি তাঁতিদের কাছ থেকে এই কম্বলগুলো কিনে নেয় তাহলে লাভবান হতে পারতেন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকরা।
বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
এএটি