ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সিরাজগঞ্জ মুক্ত হয় ১৪ ডিসেম্বর

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
সিরাজগঞ্জ মুক্ত হয় ১৪ ডিসেম্বর

সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের চুড়ান্ত মুহূর্তে এ দিনে হানাদার মুক্ত হয় সেই সময়ের মহকুমা শহর সিরাজগঞ্জ।

এর আগে ডিসেম্বরের শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে অন্য উপজেলাগুলো হানাদার মুক্ত হয়।  

একাত্তরের এ দিনটিতে প্রিয় শহর দখলে নেওয়ার পর শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা-জনতার উল্লাস। জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে দলে দলে শহরে প্রবেশ করতে থাকে হাজারো কৃষক-শ্রমিক-জনতা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে যমুনা পাড়ের এ শহরটি।  

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে সিরাজগঞ্জ মহকুমায় হানাদার থাকলেও এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনী সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করে। সেই সময় বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুলেও ব্যর্থ হন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সিরাজগঞ্জ দখলে নেয় হানাদার বাহিনী। এরপর থেকে একে একে সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাস্ত হতে থাকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। বড়ইতলী, বাগবাটি, ব্রহ্মগাছা, নওগা, বারুহাস, কৈগাড়ি ও ভদ্রঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে প্রিয় শহরকে হানাদারমুক্ত করার জন্য ৯ ডিসেম্বর বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শহরের উত্তরে শৈলাবাড়ী পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলা করেন। সেদিন হানাদারদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাহমুদ শহীদ হন। ১০ ডিসেম্বর বিশ্রাম নেওয়ার পর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর দফায় দফায় হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়। ১৩ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিন দিক থেকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। পূর্ব দিক থেকে ইসহাক আলী ও মোজাম্মেল হক, পশ্চিমে সোহরাব আলী সরকার ও লুৎফর রহমান দুদু এবং উত্তরে আমির হোসেন ভুলু ও জহুরুল ইসলামের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়। এছাড়াও দক্ষিণ দিকে আজিজ সরকার ও ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ওই দিন রাত ৩টা পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ হয়। অবেশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে টিকতে না পেরে ট্রেনে ঈশ্বরদীর দিকে পালিয়ে যায় হানাদাররা। যুদ্ধে শহীদ হন ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাবিব, সুলতান মাহমুদসহ পাঁচজন।

১৪ ডিসেম্বর সকালে মিত্র বাহিনীর বিমান সিরাজগঞ্জ জেলায় টহল দেয়। পরিত্যক্ত শত্রুশিবির লক্ষ্য করে বিমান থেকে গুলি ছোড়া হয়। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেন। ওয়াপদা অফিসে হানাদার বাহিনীর প্রধান ক্যাম্পও দখলে নেন তারা। শহরের বিএ কলেজ ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত জাতীয় পতাকা। মহুকুমা প্রশাসকের কার্যালয়, কওমি জুটমিলসহ সব সরকারি-বেরসকারি প্রতিষ্ঠানে উড়িয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের পতাকা। মুক্ত সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইসমাইল হোসেনকে এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমির হোসেন ভুলুকে।  

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মির্জা ফারুক আহম্মেদ বলেন, প্রিয় শহরকে শত্রুমুক্ত করতে আমরা ৯ ডিসেম্বর শৈলাবাড়ী পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলা চালাই। ওই দিন আমাদের সুলতান মাহমুদ শহীদ হন। ১২ তারিখে আমরা চার দিক থেকে আক্রমণ চালাই। তুমুল যুদ্ধ হয়। ১৩ তারিখ রাতে হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ১৪ তারিখ সকালে আমরা শহর দখলে নিই। এ সময় বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা-জনতা উল্লাস করতে থাকেন।  

মুক্তিযুদ্ধকালীন বেসরকারি সাব সেক্টর কমান্ড পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের চিফ-ইন-কমান্ড (সিএনসি) ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার সোহরাব আলী সরকার বলেন, সেদিন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের এক কাতারে সংগঠিত করেছেন তাদের মধ্যে আমির হোসেন ভুলু, শহীদ মহকুমা প্রশাসক শামসুদ্দিন, পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের পরিচালক আব্দুল লতিফ মির্জা (সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা), আমিনুল ইসলাম চৌধুরী (সাংবাদিক), প্রয়াত আবু মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া (সাবেক পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান), লুৎফর রহমান অরুন, জহুরুল ইসলাম, আলাউদ্দিন শেখ, ইসহাক আলী, আব্দুল হাই তালুকদার, বিমল কুমার দাস অন্যতম।  

জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসান বলেন, সিরাজগঞ্জ মুক্ত দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।  

সোমবার (১৪ ডিসেম্বর) দিবসটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে  সুর্বণ অহংকার  চত্বরে  পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের শহীদ শামসুদ্দিন সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভা হয়।  

জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য  দেন জেলা  আওয়ামী লীগের  ভারপ্রাপ্ত  সভাপতি কে এম হোসেন আলী হাসান, সহ-সভাপতি  আবু ইউসুফ সূর্য, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ  সম্পাদক  আব্দুস  সামাদ  তালুকদার, অ্যাডভোকেট বিমল কুমার দাস, ইসহাক আলী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সোহরাব আলী সরকারসহ অনেকে।

অতিরিক্ত  জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল  হোসেন এর আগে প্রজেক্টরের মাধ্যমে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস  ও সিরাজগঞ্জ  মুক্ত  দিবসের বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন।  

অপরদিকে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও সিরাজগঞ্জ মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মুক্তির সোপানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। বিকেলে দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০২০
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।