ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মুক্তিযোদ্ধাকে খাওয়াতে না পেরে, ৫০ বছরেও ডাব খাননি লক্ষ্মী

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২০
মুক্তিযোদ্ধাকে খাওয়াতে না পেরে, ৫০ বছরেও ডাব খাননি লক্ষ্মী

ঢাকা: ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ডাবের পানি না খাওয়াতে পারার কষ্টে ৫০ বছর ধরে ডাবের পানি স্পর্শ করেনি, খাননি লক্ষ্মী চক্রবর্তী।

লক্ষ্মী চক্রবর্তী বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সিপিবির নারী সেলের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্রী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে যান। ভারতে গিয়ে শরণার্থী হয়ে থাকার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। মেয়ে এবং বয়স কম হবার কারণে নার্সিংয়ের ট্রেনিং শেষে আগরতলার জিবি হাসপাতালের আহত এবং পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে।

বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাতকারে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে তার সেইসব দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তার সঙ্গে আলাপে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধকালের নানান কথা।

হাসপাতালে আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, জিবি হাসপাতালের ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আমার ডিউটি ছিল। এর একটি ছিল শিশু ওয়ার্ড, আরেকটি আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ার্ড। মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ার্ডের কথা বলতে গেলে আমি অনেকটাই অপ্রকিতস্থ হয়ে যাই। যারা মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়ে হাসাপাতালে আসতো তাদের ড্রেসিং করতাম। আমি এখনও ভাবি এমন কাজের জন্য আমি অসীম সাহসে যুক্ত হয়েছিলাম। আমার থেকেও আরও বড় দুজন দিদি ছিলেন। তারা একদিন একজন মুক্তিযোদ্ধার কাটা পা দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সাহসের সঙ্গেই এই কাজগুলো করেছি। আমার এ সাহসের সঙ্গে কাজের জন্য সবাই আমাকে ভালোবাসতেন।

কোনো মুক্তিযোদ্ধার এক হাত, দুইপা নেই, আবার কারো দুই হাত পচন ধরার ফলে কেটে ফেলতে হয়েছে। কারো এক হাত এবং এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তাদের খাওয়ানো, মাথা ধোয়ানো, ওষুধ খাওয়ানো, ইনজেকশন দেওয়া এসব কাজ করতে হতো আমাদের। সব থেকে কঠিন কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানো। কোনো একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাও ঠিকমতো খেতে পারতেন না। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা চিৎকার করে কান্নাকাটি করতেন। আমাদের দেখেও অনেক সময় হাওমাও করে কেঁদে বলতেন, আমারো তো তোমার মতো একটা বোন ছিল, যাকে পাকিস্তানের মিলিটারিরা নিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা সেই ভাইদের কান্নার কথা মনে পড়লে এখনও খুব কষ্ট লাগে।

আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে লক্ষ্মী চক্রবর্তী বলেন, বিকেল ৫টায় আমাদের ছুটি হবে, ঠিক সেই সময় দেখি হাসপাতালে সিরিয়াস একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালের বেডে নিয়ে যাওয়া হয়। দেখলাম তার গুলি লেগে বুকের মধ্যে ফুসফুস পর্যন্ত বেড়িয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে আমরা কাঁপতে থাকি। সেই মুক্তিযোদ্ধা পানি পানি বলে চিৎকার করছে। সে ডাবের পানি দেন, ডাবের পানি দেন বলে চিৎকার করে। সে ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন মুক্তিযোদ্ধা।

আমাদের ডিউটি শেষে সেদিন ফেরার সময় আমরা সবাই নিজেদের কাছ থাকা দুই-চার আনা করে চাঁদা তুললাম, ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের জন্য ডাব কিনে নিয়ে যাবার জন্য। পরের দিন ডিউটিতে যাবার সময় আমরা বটতলা বাসস্ট্যান্ট থেকে ডাব কিনি। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, হাসাপাতালের বেডে সাদা কাপড় দিয়ে শরীরটা ঢাকা। আমাদের হাতে ছিল তাকে খাওয়ানোর জন্য আনা ডাব, তখন আমাদের যে কি কষ্ট লাগলো সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। বারবার আমার মনে হচ্ছিল আমাদের যে ভাইটা দেশের জন্য জীবন দিল, তাকে আমরা একটা ডাব খাওয়াইতে পারলাম না। আজকে মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি হবে, সেই ঘটনার পর থেকে আমি আর কোনোদিন ডাব খাইনি। এমনকি আমার বাড়িতেও ডাব আনা হয় না। ডাব দেখলেই আমার সেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের কথা মনে পরে। সেই মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের জন্য আমি ডাবের পানি আমার জীবন থেকে উৎসর্গ করছি। আমি যতদিন বাঁচবো কোনোদিন ডাব পানি স্পর্শ করবো না। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কষ্ট, এটা আমার জীবনের একটা বড় কষ্ট।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে হাসাপাতালের ঘটনার উল্লেখ করে লক্ষ্মী চক্রবর্তী বলেন, হাসপাতালের পাশে একটা মাঠের মত জায়গা ছিল। দেখি সেখানে একের পর এক বড় বড় মিলিটারি ভ্যান প্রবেশ করছে। ভ্যানের মধ্যে আমরা দেখি কিছু মিলিটারি এবং মেয়ে মানুষ রয়েছে। দূর থেকে আমরা ঘটনা বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমরা কাছে গিয়ে দেখি, ভ্যান মেয়েদের নামাচ্ছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কুমিল্লা ময়নামতির বিভিন্ন স্থানে বাঙ্কার করেছিল। এসব বাঙ্কারে গ্রামের গৃহবধূ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের নিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন করছে। মেয়েদের যখন নামাচ্ছিল, তাদের কি বীভৎস দেখাচ্ছিল সেটা বর্ণনা করে বলা যাবে না।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে অনেক মেয়ে গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে চাইতেন, তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের কোন কাপড় পড়তে দিতো না, আবার অনেকেই নিজের শরীরের চুল গলায় পেঁচিয়ে ফাঁসি নিয়ে মারা যেতে চাইতো, তাই তাদের চুল কেটে দেওয়া হতো। এসব মেয়েদের ময়নামতির বিভিন্ন বাঙ্কার থেকে উদ্ধারের পর তাদের শরীরে কোনও কাপড় ছিল না, ভারতের শিখ সেনাবাহিনীর ভাইয়েরা, তাদের মাথার পাগড়ি ছিড়ে ছিড়ে মেয়েদের পরতে দিয়েছিল। তারপরেও অনেকের শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। আমাদের কাছে কোনো ক্যামেরা ছিল না, সেইসব ছবি যদি তুলতে পারতাম, তাহলে বাংলাদেশকে আমি যে কি সম্ভার দিতে পারতাম। মুক্তিযুদ্ধের যে কী বিভীষিকাময় দৃশ্য ছিল আমাদের চোখের সামনে। অনেক কষ্ট, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা দেশটাকে পাইছি।

পাকিস্তানিদের নারী নির্যাতনের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, নির্যাতনের ফলে এরা সবাই উন্মাদ হয়ে পড়েছিল। মেয়েদের কারো কোনো চেতনা বলতে কিছু ছিল না। অনেকেই নিজের নামটাও বলতে পারেনি হাসপাতালে ভর্তির সময়। তারা মানুষ দেখলেই মারার জন্য তেড়ে আসতো। এসব মেয়েদের শরীরের বিভিন্নস্থানে নির্যাতনের ফলে পচন ধরে গিয়েছিল। তাদের সেই ক্ষতস্থান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতো। আমাদের বোনদের এমন বীভৎস চেহারা আমি দেখেছি।

আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্বাধীন দেশে সুবর্ণ চড়ে নারী লাঞ্ছিত হয়, বেগমগঞ্জে ধর্ষণ হয়, তনু নির্যাতিত হয়, স্বাধীন বাংলাদেশেও আমাদের এসব দেখতে হয়। আমরা কী এসব সইতে পারি। আমরা আজ জীবন্মৃত। আমরাও ব্যর্থ নারীদের নিরাপদ রাখতে, সরকারও ব্যর্থ নিরাপত্তা দিতে।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২০
আরকেআর/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।