ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা 

সুমন কুমার রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২০
প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা 

টাঙ্গাইল: তথ্য গোপন করে সরকারি চাকরি করার অভিযোগ উঠলেও রহস্যজনক কারণে বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার শাহনাজ পারভীন রূপা ওরফে রিপা (২৩)।  

একাধিক বিয়ে হলেও নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে বিত্তবান পরিবারের যুবকদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও এখনও পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
 
এদিকে, বিষয়টি সবার নজরে এলে শাহনাজ পারভীন রূপা ওরফে রিপা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সব কাগজপত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংশোধনের জন্য দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন। নিজেকে নিদোর্ষ সাজাতে ঘনিষ্টতা তৈরি করেছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সঙ্গেও।  
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ইউনিয়নের একাধিক ইউপি সদস্য বাংলানিউজকে জানান, টাঙ্গাইলের স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক শরীফ নজরুল ইসলামকে পালক পিতা সাজিয়ে মেয়ে পরিচয় দেওয়ায় ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া, চেয়ারম্যানের সঙ্গে ইদানিং ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে রূপার। স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক ও ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে সম্পর্কের পরিচয় দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক সদস্য ও কর্মচারীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। লোকমুখে শুনি যে কাজী অফিসে বিয়ে করতে গেলেও রূপা ও চেয়ারম্যানের বিয়ে পড়াতে অস্বীকৃতি জানান কাজী।

যদুনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর ফিরোজ আহমেদ তার বিরুদ্ধে রূপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সরকারি চাকরির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে তিনি তথ্য গোপন করে চাকরি নিয়েছে কিনা। জন্ম ও মৃত্যু সনদের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর লাগে তখন আমি স্বাক্ষর দিয়েছি। রূপার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ কোনো সম্পর্ক নেই।

জানা যায়, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-তে রূপা চাকরির জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। সেখানে নিজেকে অবিবাহিত উল্লেখ করে স্থানীয় ও বর্তমান ঠিকানার জায়গায় পিতার নাম শামছু উদ্দিন, মা হেলেনা খাতুন, গ্রাম দাত্তাপাকুটিয়া, উপজেলা ফুলবাড়িয়া, জেলা ময়মনসিংহ আবেদন করে তিনি। ২০১৮-২০১৯ সালে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরে নিজেকে অবিবাহিত এবং পিতা মাতার নাম শামছু উদ্দিন, মাতা হেলেনা খাতুন, গ্রাম মমিনপুর, উপজেলা ধনবাড়ী উল্লেখ করে তিনি।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ধনবাড়ী উপজেলার যদুনাথপুর ইউপি সদস্যকে ম্যানেজ করে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার দাত্তাপাকুটিয়া গ্রামের মামা শামছু উদ্দিন, মামী হেলেনা খাতুনকে বাবা-মা সাজিয়ে ধনবাড়ী উপজেলার মমিনপুর গ্রামের স্থানীয় ও বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করে জন্ম সনদ ও নাগরিকত্ব সনদ হাসিল করেন রূপা।

শাহনাজ পারভীন রূপার শিক্ষাগত সনদপত্র ও সরকারি চাকরিতে আবেদন এবং কাবিননামায় যে তথ্য দিয়েছে তার একটির সঙ্গে আরেকটির মিল নেই। রূপার প্রথম বিয়ে হয় ২০১২ সালে রোকনুজ্জামানের সঙ্গে প্রথম বিয়ে হয়। এরপর ২০১৪ সালে মনির হোসেনের সঙ্গে। তবে এই কাবিননামায় রূপা তাকে কুমারি দাবি করেন। দুটি কাবিন নামায় রূপার মার জাতীয় পরিচয়পত্র শিউলি বেগম (৯৩২১২০৪৩৫৭৪০), স্বামী ইদ্রিস আলী মণ্ডল, মাতা কুলসুম বেগম। পিতা ইদ্রিস আলী মণ্ডল (৯৩২১২০৪৩৫৭৩৫), পিতা চান মিয়া মণ্ডল, মাতা ছাহেরা বেগম রয়েছে। তার এসএসসি ও এইচএসসি সনদ পত্রে একই নাম থাকলেও বর্তমানে দেখা যায়, বাবা শামছ উদ্দিন ও মাতা হেলেনা খাতুন।  

কাবিন নামা ও শিক্ষাগত সনদপত্রে এবং জাতীয় পরিচয় পত্রে বাবা-মা’র নাম ভিন্ন রকম রয়েছে। এ তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়লে কাগজপত্র সংশোধনে ছুটোছুটি করছেন শাহনাজ পারভীন রূপা। ইতোমধ্যে তার শিক্ষাগত সনদপত্রে বাবা-মায়ের নাম পরিবর্তন করেছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে আবেদন দিয়েছেন জেলা নির্বাচন অফিসেও।

এ বিষয়ে, সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, তার জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য আমাদের অফিসে আবেদন করেছেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে তার জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন হওয়ার মতো হলে সংশোধন করা হবে।

জেলা প্রশাসক আতাউল গনি বাংলানিউজকে জানান, এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

তথ্য প্রমাণে জানা যায়, ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে পার্শ্ববর্তী মধুপুর উপজেলার আম্বাড়ীয়া গ্রামের হায়দার আলীর ছেলে রোকনুজ্জামানের সঙ্গে পারিবারিকভাবে রূপার বিয়ে হয়। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় পরকিয়া প্রেমে পালিয়ে গিয়ে রোকনুজ্জামানের বন্ধু একই উপজেলার মোল্লাবাড়ী এলাকার মৃত হাজী শহীদ আলীর ছেলে মনির হোসেনের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এরপর আগের দুটি বিয়ের তথ্য গোপন ও পিতা মাতা এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে তৃতীয় বিয়ে করেন নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার ইতনা গ্রামের মৃত জালাল বিশ্বাসের ছেলে বিএম সোহেল রানাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যদুনাথপুর ইউনিয়নের একাধিক ব্যক্তি জানান, শাহানাজ পারভিন রূপা বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে একাদিক বিয়ে করেছে। তাদের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে তাদের তালাকও দিয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান মীর ফিরোজ আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এছাড়াও তার বাবা-মা’র নাম গোপন করে সরকারি চাকরি করছেন। তথ্য গোপন করে চাকরি নিলেও কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

শাহনাজ পারভীন রূপার সাবেক স্বামী নড়াইলের বিএম সোহেল রানা জানান, তার সঙ্গে মোবাইলে পরিচয় হয়। তারপর প্রেমের সম্পর্কে গড়ে উঠলে পরিবারের অমতেই ঢাকায় বিয়ে করেন। বিয়ের কয়েকমাস পর নড়াইলে সংসার শুরু করলে সেখানে এক বন্ধুর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলেন রূপা। বিষয়টি জানাজানি হলে এবং হাতেনাতে ধরা পড়লে এলাকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা শালিশী বৈঠকের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। পরবর্তীকালে রূপাকে তালাক দেন তিনি।

শাহনাজ পারভীন রূপার অপর সাবেক স্বামী মনির হোসেন জানান, রূপার স্বামী থাকা সত্ত্বেও তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সে কারণে বিয়ে করে প্রায় ছয় মাসের মতো সংসার করেন। এ সময়ে রূপা বেশ মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অপর ছেলের সঙ্গে মোবাইলে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সে কারণে রূপাকে তালাক দিয়েছিলেন মনির হোসেন।

তিনি আরো জানান, শুধু তাকেই নয়, এরকমভাবে অনেক ছেলেকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে পরবর্তীকালে অন্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন রূপা।

অপরদিকে, প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার অভিযোগে রূপার বিরুদ্ধে টাঙ্গাইল আদালতে মামলা দায়ের করেছেন মিজানুর রহমান নামে এক যুবক। আসামিরা হলেন, ধনবাড়ী উপজেলার মমিনপুর গ্রামের ইদ্রিস আলী মণ্ডলের মেয়ে শাহনাজ পারভীন রূপা ওরফে রিপা (২৩), রুপার বোন সিমা আক্তার (১৯), রুপার মাতা শিউলি বেগম।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শাহনাজ পারভীন রূপার মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি জানান, মামলা চলছে, এ বিষয়ে এখন কিছু বলবো না।

বাংলাদেশ সময়: ২২০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।