খুলনা: বিদায় নিচ্ছে ২০২০ সাল। কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আরেকটি বছর।
স্মৃতিবিজড়িত ২০২০ সালে খুলনায় ঘটনা-দুর্ঘটনার মাঝে কিছু প্রাপ্তিও মিলেছে। ২০২০ সালে অনেক লোমহর্ষক ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছে খুলনা। সবচেয়ে বেশি খুলনাবাসীকে মর্মাহত করেছে শিল্পাঞ্চল খ্যাত খালিশপুর ও দৌলতপুরের রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ ও ভয়াবহ ধর্ষণ এবং সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনাগুলো।
মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, বকেয়া বেতন পরিশোধসহ ১১ দফা দাবিতে তীব্র শীত উপেক্ষা করে ১ জানুয়ারি বছরের প্রথমদিনও খুলনার ৭টি পাটকল শ্রমিকরা আমরণ অনশন পালন করেন। এরপর দিনপঞ্জিকার পাতা উল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা।
নারী ও শিশু ধর্ষণ:
৪ জানুয়ারি খুলনায় মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে আরিফ বিল্লাহ ওরফে রাজন নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৭ ফেব্রুয়ারি খুলনার রূপসায় এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে শ্রীফলতলা ইউনিয়নের ইদ্রিস মল্লিকের ছেলে ইমদাদুল মল্লিককে (২৪) আটক করে পুলিশ। এছাড়া খুলনায় গত ১ নভেম্বর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চার নারী ও শিশুসহ গত তিন মাসে অর্ধশত নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
জেলার বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া এবং নগরীর খালিশপুর থানা এলাকায় ৪ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে ৩ নভেম্বর ডুমুরিয়ার বানিয়াখালী এলাকায় পঞ্চম শেণির ছাত্রীকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে একই এলাকার সাব্বির হোসেন নামে এক যুবক।
একই দিন নগরীর খালিশপুরের বাংলার মোড় এলাকার এক গৃহবধূ পাওনা টাকা আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায় ধর্ষণের শিকার হয়ে এক মাদ্রাসাছাত্রী (১২) তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অপরদিকে, বটিয়াঘাটা উপজেলার সুকদাড়া এলাকায় ১২ বছর বয়সী এক মাদ্রাসাছাত্রীকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে ধর্ষণ করেছেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সঞ্জয় শীল (৫০)।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সূত্রে জানা যায়, তিন মাসে ৫৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে ওসিসিতে এসেছে। এর মধ্যে ৯ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। অন্যদের বয়স ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে ও ৬৫ বছরের মধ্যে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের শিকার হন নগরীর খালিশপুর এলাকায় ৬৫ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধা। এছাড়া বেশিরভাগ ঘটনাই খুলনার রূপসা, তেরখাদা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও পাইকগাছা উপজেলার।
কয়রা উপজেলার বালিয়াপুর গ্রামের সাড়ে ৪ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে গত ১৮ আগস্ট ওসিসিতে ভর্তি হয়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর তেরখাদা উপজেলায় পুলিশ সদস্য চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী (৯) ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় পুলিশ উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের মোকামপুর গ্রামের রেজাউল ইসলামকে (২২) গ্রেফতার করে। তিনি নাটোর পুলিশ লাইন্সে কর্মরত। ধর্ষক রেজাউলের বাবাও পুলিশে চাকরি করেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম জাবুসা এলাকায় দ্বিতীয় শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থী তার খালার বাসায় বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়।
খুলনার পাইকগাছায় লস্কর-পাইকগাছা ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ২ ডিসেম্বর মাদ্রাসার সুপারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আলোচিত ট্রিপল মার্ডার:
২০২০ সালে খুলনায় আলোচিত ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী গ্রামে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে গুলি করে তিনজনকে হত্যা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় মশিয়ালী গ্রামের মৃত বারিক শেখের ছেলে মো, নজরুল ইসলাম (৬০), একই এলাকার মো. ইউনুছ আলীর ছেলে গোলাম রসুল (৩০) এবং পরে গুলিবিদ্ধ এলাকার সাইদুল ইসলামের ছেলে আটরা মেট্রো টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সাইফুল ইসলাম (২২) খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
এ ঘটনায় খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহ-প্রচার সম্পাদক শেখ জাকারিয়া হোসেন জাকার, তার ভাই মহানগর ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সহ-সভাপতি শেখ জাফরিন, অস্ত্র মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি মিল্টনসহ এজাহারভুক্ত অধিকাংশ আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
সড়ক দুর্ঘটনা:
২০২০ সালটিতে খুলনায় অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। ৮ অক্টোবর ডুমুরিয়া মহিলা কলেজ মোড়ে ও জিলেরডাঙ্গা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত হন। ৫ অক্টোবর খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের খর্ণিয়া সেতুতে ট্রাকে ত্রিখন্ডিত হয়ে এক বৃদ্ধ (৭০) নিহত হন। ২৮ সেপ্টেম্বর খুলনার ডুমুরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় এক গ্রাম্য চিকিৎসক নিহত হন। ১৮ মার্চ এ সড়কের কাঁঠালতলা বিশ্বাস বাড়ির সামনে ট্রাকের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে ডিজিএফআই কর্মকর্তা তারিয়েফ সুনাম দীপ (৩০) নিহত হন। সবশেষ ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে ১২ ডিসেম্বর নিয়ন্ত্রণ হারানো বাসের চাপায় সাব্বির হোসেন (১৫) ও রাকিবুল হাসান (৫) নামে আপন দুই ভাই নিহত হয়।
চলতি বছরে খুলনা বিভাগের সব থেকে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের ডুমুরিয়ার অংশে। সেখানে প্রায় প্রতি তিনদিনে গড়ে একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ব ৯ পাটকল বন্ধ:
পাটকলের কারণে শিল্পাঞ্চলখ্যাত ছিলো খুলনা। কিন্তু ২০২০ সালের ২ জুলাই রাতে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ জুট মিলস্ করপোরেশনের (বিজেএমসি) নিয়ন্ত্রণাধীন খুলনাঞ্চলের ৯টিসহ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ২৫টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের অবসায়ন (অব্যাহতি) করা হয়। সরকারি আদেশে পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় থমকে গেছে সব কার্যক্রম। এতে বেকার হয়ে গেছে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী।
করোনায় ঝরেছে প্রাণ:
এপ্রিল মাসে খুলনা জেলায় প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী (৬২) শনাক্ত হয়। আক্রান্ত রোগীর বাড়ি মহানগরীর ছোট বয়রা এলাকায়। এরপর একে একে খুলনায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ ঝড়েছে ১১২ জনের।
সুসংবাদ:
২০২০ সালে অনেক দুসংবাদের মধ্যেও খুলনাবাসীর জেন্য কয়েকটি সুসংবাদ এসেছে। তার মধে অন্যতম হচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন। বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়ে স্পেনের সিমাগো ল্যাব ও যুক্তরাষ্ট্রের স্কপাস পরিচালিত বিশ্বের ৭০২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত (ইনডেক্স জার্নাল ভিত্তিক) জরিপে ২০২০ সালে ফের আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে স্থান করে নেয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথম এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যায়ের সামগ্রিক অবস্থান এবার এগিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে উদ্ভাবনীতে গতবছরের চেয়ে ২৮ ধাপ এগিয়ে ৪২১ তম স্থানে এবং দেশের মধ্যে প্রথম, সামাজিক প্রভাব ক্যাটাগরিতে অবস্থান ৫ ধাপ এগিয়ে এ বছর ২৩৭ এবং দেশের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। তবে গবেষণায় গত বছরের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে ৪৯৫তম স্থানে রয়েছে এবং দেশের মধ্যে ১০ অবস্থানে রয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সার্বিক ক্যাটাগরিতে গতবছরও দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, এবছরও সেই অবস্থান অক্ষুণ্ন রয়েছে।
এছাড়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান অধ্যাপক ড. মো. হারুনর রশীদ খান গুগোল স্কলার সাইটেশনের সংখ্যা অনুযায়ী বিশ্বসেরা পদার্থ বিজ্ঞানীদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন এ বছর। ওই সংস্থা কর্তৃক বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানীদের সাইটেশনের সংখ্যা ভিত্তিতে প্রথম ৯০০জনের মধ্যে তিনি স্থান লাভ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে খুলনায় ‘শেখ হাসিনা মেডিক্যার বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা, আইন, ২০২০’ স্থাপনের জন্য এ সংক্রান্ত আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার। ২১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ভার্চ্যুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে এর খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ভীষণ খুশি খুলনাবাসী।
বাংলাদেশ সময়: ২১২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২০
এমআরএম/ওএইচ/