ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

এ যেন পাহাড় কাটার মহোৎসব!

মেহেদী নূর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২২
এ যেন পাহাড় কাটার মহোৎসব!

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: পৃথিবীর লোহ দণ্ড বলা হয় পাহাড়কে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

এর ওপর ভর করেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অথচ এক শ্রেণির ভূমিদস্যুরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সেই পাহাড়গুলোকে সাবাড় করছে। সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক পাহাড় রয়েছে। তবে সেসব পাহাড়গুলোতেও পড়েছে ভূমি খোকোদের থাবা। নিজস্ব ফায়দা লুটতে পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রি, আবাস্থল গড়ে তোলাসহ নানা স্বার্থে এসব পাহাড়গুলোকে নির্বিচারে বিলীন করে দিচ্ছে।

সকাল থেকে রাত সমান তালে চলে পাহাড় কাটার কাজ। তবে বেশিরভাগ সময়ে নিঝুম রাতে চলে বনাঞ্চলের আবৃতে ঘেরা পাহাড় কাটার ধুম। বিগত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধেকের চেয়ে বেশি পাহাড় ও টিলা কেটে সমতল করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মাঝে চাপা ক্ষোভ থাকলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতেও পারছেন না। প্রভাবশালী মহলটি ক্ষমতার দাপট ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাতের আধাঁরে পাহাড়ের মাটি কেটে সাবাড় করে ফেলছে। ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকি মুখে পড়েছে।  

সরেজমিন উপজেলার গোপীনাথপুর ও বায়েক ইউনিয়নের গ্রামগুলো ঘুরে দেখা যায়, উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে মাটি কেটে করা হয়েছে সমতল। পাশেই অস্থিত হারানোর পাহাড়ের ক্ষত চিহ্ন। কোথাও কোথাও পাহাড়ের বুক চিরে সমতল করা জায়গায় স্থানীয় এক শ্রেণির বাসিন্দারা ঘর নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। যেন পাহাড় কাটার উৎসবে নেমেছে তারা। সে সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ নিধন করে ফেলছে। প্রকৃতির বুকে মানুষের এমন থাকায় জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড়ের মাটি কাটার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে অধ্যাধুনিক ভেকু মেশিন। যার মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে পাহাড়ের মাটিগুলোকে কেটে ফেলা হচ্ছে। মাটি কেটে সেগুলোকে টাক্টরে করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। আবার অনেকেই গর্ত বা জমি ভরাট করে ঘর বাড়ি নির্মাণ করছে।

স্থানীয় সচেতন মহল জানান, যেভাবে নির্বিচারে ও অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে তা জনজীবনে হুমকি স্বরূপ। পাহাড়ের তলে কিংবা পাহাড়ে যেসব বাড়িঘর রযেছে ভারী বর্ষণে যেকোনো মুহূর্তে ধসে যেতে পারে। এতে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকাও রয়েছে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বাংলানিউজকে বলেন, পাহাড় কাটা বেআইনি কিনা তা আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে কেউ আমাদের অবহিত করেনি। অনেকেই পাহাড় কেটে বাড়িঘর নির্মাণ করেছে। বিনা বাঁধায় মাইলের পর মাইল পাহাড় সাবাড় করা হয়েছে। পাহাড় কাটার বিষয়ে আমাদের যথাযথ জ্ঞান না থাকায় আমরা আমাদের পারিবারিক প্রয়োজনে পাহাড় অংশ কাটা শুরু করলেও এখন তা বন্ধ করে দিয়েছি।

স্থানীয় বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বিগত ৪-৫ বছর ধরে পাহাড় কাটা শুরু হয়েছে। আমাদের দুটি ইউনিয়নে প্রায় তিন ভাগের মধ্যে দুই ভাগই পাহাড় কেটে ফেলেছে। যদি প্রশাসন কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে আর কিছুদিন পর এখানে আর কোন পাহাড় খুঁজে পাওয়া যাবে না।

গোপীনাথপুর গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আক্কাছ আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের বাপ-দাদা আমল থেকে দেখে আসছি এ পাহাড়গুলো। শত শত বছরের এ পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে আমরা বড় হয়েছি। অথচ একটি ভূমিদস্যু মহল এ পাহাড়গুলো অবাধে কেটে ফেলছে। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের জায়গাগুলো অনেক উঁচুতে। সেখানে বৃষ্টিপাতের পানিগুলো আমাদের দেশে প্রবেশ করলে পাহাড়ের কারণে ড্রেনগুলো দিয়ে সরে যেত। এখন পাহাড়গুলো কেটে ফেলায় ভারত থেকে বৃষ্টির পানি সহজে প্রবেশ করে আমাদের নিচু এলাকা প্লাবিত করছে। এতে আমাদের ফসলি জমিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা আর্থিকভাবে অনেক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে এলাকার আমজাদ মাস্টার তার ভাই মুক্তার ও মান্না ছাড়াও প্রভাবশালী একটি চক্র এতে জড়িত থাকায় সাধারণ মানুষ ভয়ে মুখ খুলছেন না। চক্রটি অবৈধভাবে গভীর রাতে ভেকু মেশিনের মাধ্যমে পাহাড়ের মাটি কেটে নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আমজাদ মাস্টার বলেন, পাহাড় কাটার সঙ্গে আমি আমার ভাইয়েরা জড়িত নয়।  

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন কসবা উপজেলার সভাপতি সোলাইমান খান বাংলানিউজকে বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়ে আমরা সুশীল সমাজ প্রতিবাদ করে আসছি। প্রশাসন কখনও কখনও ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও আবার থমকে যায়। প্রভাবশালীর মহলের সঙ্গে ভূমি কর্মকর্তরা জড়িত বলে মনে করছি। দিন দিন পাহাড়ি জনপদগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ স্থানগুলো পর্যটনের স্পট হতে পারতো। পাহাড় রক্ষায় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি রেকর্ডে পাহাড় বা টিলা চিহ্নিত না থাকলে পরিবেশ আইনে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। তবে অন্য আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।  

এ বিষয়ে কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ উল আলম বাংলানিউজকে বলেন, পাহাড় কাটা সম্পূর্ণ একটি বেআইনি কাজ। এটি কোনোভাবে গ্রহণ যোগ্য নয়। আমরা খবর পেয়েছি একটি চক্র গভীর রাতে পাহাড়ের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা অভিযান চালালে উপস্থিতি টের পেয়ে ওই মহলটি পালিয়ে যায়। সার্বক্ষণিক বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।