ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ফাগুনে স্বর্ণালি মুকুলের সৌরভ

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৩ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০২২
ফাগুনে স্বর্ণালি মুকুলের সৌরভ

রাজশাহী: এবার আগুন ঝরা ফাগুনে ছন্দ ফিরে পেয়েছে শ্যামল প্রকৃতি। ফুলে-ফলে সুরোভিত হয়ে উঠেছে সবুজ অরণ্য।

পত্র-পল্লবে দোল দিচ্ছে মৃদু-মন্দ দখিনা বাতাস। শীতের আড়মোড়া ভেঙে যেন জাগরুক হয়ে উঠেছে প্রাণীকূল।  

ঋতুরাজ বসন্তের আবাহনে ফুটেছে শিমুল, পলাশ। সবুজ আম্রকাননে কঁচি পাতার ফাঁকে ঝিলিক দিচ্ছে স্বর্ণালি মুকুল। কখনও কখনও ওই দূর সীমানা থেকে ভেসে আসছে কোকিলের কুহু কুহু কলতান।
আগুনরাঙা গাঁদা ফুলের সঙ্গে মিষ্টি সৌরভ ছড়াচ্ছে সোনাঝরা আমের মুকুলও।
আমের মুকুলের ঘ্রাণে এখনই মৌ মৌ করছে চারিদিক। গুচ্ছ গুচ্ছ মুকুলের চারপাশে তাই এখন চলছে মৌমাছিদের গুঞ্জরন। দিনের তাপমাত্রা যতই বাড়ছে স্বর্ণালি মুকুলগুলো ততই পাচ্ছে পূর্ণতা। দানা বাঁধছে ফুলে, আর স্বপ্ন কৃষকের মনে।

বছর ঘুরে ঋতুর পালাবদলে আমের শহর রাজশাহীর প্রকৃতি এখন এমনই বৈচিত্র্যময় আর এমনই আবেগের। বসন্ত, ফাগুন আর আমের মুকুল যেন এখানে একই সুতোয় গাঁথা। আর তাই নিরাশ করেনি প্রকৃতিও। রাজশাহীর গাছে গাছে এখন মুকুলের সৌরভ। বাগান তো বটেই বাড়ির আঙিনায় থাকা গাছেও মুকুল এসেছে এবার। সোনারাঙা সেই মুকলেই এখন স্বপ্ন বুনছেন রাজশাহীর আমচাষিরা।

আমের রাজধানী বলে কথা। কী হবে আর কী হবে না- সেই চিন্তাই এখন সবার মাথায়। বড় ধরনের কোনো ঝড়-ঝঞ্ঝা না হলে এ বছর আমের ফলন রেকর্ড ছাড়াবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ, প্রান্তিক আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা।

বছরের নির্দিষ্ট এ সময়টাজুড়েই তাই রাজশাহীর আমচাষি ও ব্যবসায়ীসহ কমবেশি সব শ্রেণির মানুষেরই নজর থাকে আম বাগানের দিকে। ফাগুনের বাতাসে আমের সবুজ পাতা আর মুকুলই কেবল নয় এখন সেই বাতাসে দোল খাচ্ছে কৃষকের রঙিন স্বপ্নও। প্রতিবছর আমের মৌসুমে প্রায় আটশ কোটি টাকার ব্যবসা হয় রাজশাহীতে। আমকে কেন্দ্র করেই মূলত চাঙা হয়ে ওঠে রাজশাহীর অর্থনীতি। যার মোট আয় যুক্ত হয় দেশের প্রবাহমান অর্থনীতিতেও। আম লাভজনক মৌসুমি ফল ব্যবসা হওয়ায় তাই প্রতিবছরই বাগানের সংখ্যা ও পরিধি বাড়ে।  

তবে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে হালে গড়ে ওঠা নতুন আম বাগানগুলোর প্রায় সবই বনেদি জাতের। বিশেষ করে নিয়মিত জাত গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত (হিমসাগর), ল্যাংড়া ও আশ্বিনা জাতের হাইব্রিড গাছই এখন বেশি হচ্ছে।

সাধারণত মাঘ মাসের শেষে রাজশাহীর আমবাগানগুলোতে মুকুল আসতে শুরু করে। তবে ফাল্গুন মাসের শুরুর দিকেই বেশি গাছে আমের মুকুল এসেছে। যা অনেক ভালো লক্ষণ বলেই জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। কারণ একটু দেরিতে মুকুল এলে ছত্রাক আক্রান্ত হয়ে ঝরে যাওয়ার শঙ্কা কম থাকে। আগে রাজশাহীতে আমের মৌসুমে ‘অফ ইয়ার’ ও ‘অন ইয়ার’ বলে একটা ফলনকালীন হিসেব প্রচলন ছিল। ওই সময় অন ইয়ারে বেশি ফলন ও অফ ইয়ারে কম হত।  

কিন্তু আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকরা সেই প্রথাকে পেছনে ফেলেছেন প্রায় এক যুগের বেশি হলো। রাজশাহীর গবেষক ও আম চাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফলনের সেই রেওয়াজ ভেঙেছে। এখন প্রতিবছরই আমের গাছে মুকুল আসে এবং পর্যাপ্ত ফলন হয়। আম চাষিরা বছরজুড়েই আম গাছ ও আম বাগানের নিয়মিত পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকেন। ফলন শেষে পাতা ও ডাল ছাটা, গাছের গোড়ায় সেচ দেওয়া, মুকুল আসার আগে এবং পরে যত্ন নেওয়া হয়। কৃষি বিভাগের পরামর্শে নির্দিষ্ট সময় ছত্রাকনাশক স্প্রে করায় এসবই চলে পুরো বছরজুড়ে। যে কারণে রাজশাহীর সব বাগানে এখন প্রতিবছরই আমের আশানুরূপ ফলন হচ্ছে এবং বাড়ছে।

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পবানা, নওগাঁ ও জয়পুরহাটসহ পুরো বিভাগজুড়েই এখন আমের চাষ হচ্ছে। মৌসুমের শুরু হওয়ায় এখন প্রতিদিনই চলছে আম গাছের পরিচর্যা। আমগাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে উঁচু করে দেওয়া হচ্ছে সেচ। গেল কয়েক বছর থেকে করোনায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আম চাষিরা। কিন্তু সংক্রমণ কমে আসায় এবার সেই কয়েক বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য শুরু থেকেই প্রাণপণ চেষ্টা করছেন স্থানীয় আম চাষিরা।

রাজশাহী মহানগরের শালবাগান এলাকার মিনার খন্দকার। তিনি একাধারে আম চাষি ও ব্যবসায়ী। রাজশাহীর পবা ও মোহনপুরে তার একাধিক আম বাগান রয়েছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমের মৌসুমকে ঘিরেই অনেক কৃষকের জীবন ও জীবিকা চলে। প্রতিবছর আম বিক্রি করেই অনেক চাষি ঋণ পরিশোধ করেন, মেয়ের বিয়ে দেন, নিজের চিকিৎসা খরচ জোগান, সুদ-আসল দিয়ে বন্ধকি জমির কাগজ ছাড়ান। তাই গাছ, মুকুল আর আম অনেকেরই বেঁচে থাকার মূল অবলম্বন। একবার ফলন হলেও তাই বছরজুড়েই বাগান পরিচর্যা করেন।

এবার প্রায় সব গাছেই মুকুল এসেছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেই ভালো। তাহলে আশানুরূপ ফলন মিলবে বলে জানান মিনার খন্দকার।

জানতে চাইলে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবদুল আলিম বাংলানিউজকে বলেন, পুরোপুরিভাবে শীত বিদায়ের আগেই আমের মুকুল আসা ভালো নয়। হঠাৎ হঠাৎ ঘন কুয়াশা আম গাছের মুকুলের কাল। ঘন কুয়াশায় মুকুলের ক্ষতি হয়। পাউডারি মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হয়ে অধিকাংশ মুকুল ঝরে যায়। এবার দেরিতে মুকুল আসায় তেমন হয়নি। এতে ভালো ফলন হবে বলেও আশা করা যায়। তবে এরপরও মুকুল রক্ষায় আম চাষিদের স্প্রে করতে হবে।  

এক লিটার পানিতে ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের এক মিলি ‘ইমিটাফ’ এর সঙ্গে দুই গ্রাম ‘ডাইফেন এম-৪৫’ মিশিয়ে আমের মুকুলে স্প্রে করতে হবে। একইভাবে মুকুল যখন মটর দানা বাঁধবে তখন আরও একবার এ স্প্রে করতে হবে।  

আর যদি আমের মুকুলে পাউডারি মিলডিউ রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে গাছে ‘থিয়োভিট’ স্প্রে করতে হবে। এর মাত্রা হবে প্রতিলিটার পানির জন্য থিয়োভিট দুই গ্রাম। এছাড়া এখনই গাছের গোড়ায় সেচ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।  

তিনি আরও বলেন, এখনকার আবহাওয়া রৌদ্রজ্জ্বল। আর তাপমাত্রাও একটু একটু করে বাড়ছে। আমের মুকুলের জন্য এমন আবহাওয়া উপযোগী। শেষ পর্যন্ত প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে এ বছর প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলন মিলবে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীতে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে। প্রতি হেক্টরে ১২ মেট্রিক টন ফলন হয়। অর্থাৎ ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে ২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন আম হয়। গতবার এ পরিমাণ আমই উৎপাদন হয়েছে। আর গতবারের ফলনই চলতি মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রা হয়।  

সেই হিসেবে রাজশাহীতে এবার ২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন ফলন ভালো হলে এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, আর কম হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এখন পর্যন্ত আমের ফলনের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। বৈশাখে ঝড়-ঝঞ্ঝা বেশি না হলে এবার রাজশাহীতে ৮০০ কোটি টাকার আমের ব্যবসা হবে বলে আশা করা হচ্ছে বলে যোগ করেন- রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
 
রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় আড়ইশ জাতের সুস্বাদু ও রসালো মিষ্টি আমের ফলন হয়। তবে এবার জাতআম গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ক্ষিরসাপাত (হিমসাগর), বোম্বাই, ফজলি, আম্রপলি, আশ্বিনা, ক্ষুদি, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপুরী, দুধসর, লকনা ও মোহনভোগ জাতের আম বেশি চাষ হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০২২
এসএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।