ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবল্লাহ হত্যার এক বছর আজ

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবল্লাহ হত্যার এক বছর আজ

কক্সবাজার: কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়ায় আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের এক বছর আজ। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ঘর থেকে ডেকে এনে সংগঠনের কার্যালয়ে তাকে গুলি করে করা হয়।

এ ঘটনার পরে এ মামলায় পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে তাকে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) সন্ত্রাসীরা এমনকি আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুননীর নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা শিবিরে চরম নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। নিরাপত্তার অভাবে এক বছরের মধ্যে দুই দফায় মুহিবুল্লাহর মা ও স্ত্রী, নয় সন্তান, ভাই ও ভাইয়ের পরিবারের সদস্যসহ ২৫ জন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির থেকে কানাডায় পাড়ি দিয়েছেন।

সর্বশেষ গত রোরবার (২৬ সেপ্টেম্বর) মুহিবুল্লাহর মা উম্মা ফজল, দুই ভাই হাবিব উল্লাহ ও আহমাদ উল্লাহ, তাদের স্ত্রী ও সন্তানসহ ১৪ জন রোহিঙ্গা শিবির থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং সোমবার রাতে তারা কানাডার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।  

বিচারের অপেক্ষায় মুহিবুল্লাহ মামলা:

২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর তার ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে মামলাটির তদন্ত শেষে গত ৩০ জুন ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) সালাহ উদ্দিন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৩৮ জনকে।  

বর্তমানে মামলাটির অভিযোগ গঠন শেষে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানান কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম।

আলোচিত এ হত্যা মামলার বিচারিক কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার প্রচেষ্টা রয়েছে। এ মামলার ২৯ আসামির মধ্যে ১৪ জন জেলে রয়েছেন। একজন মারা গেছেন। বাকি ১৪ জন আসামি পলাতক রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পিপি ফরিদুল।

মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করে আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, মুহিবুল্লাহর শূন্যস্থান পূরণ করার নয়। রোহিঙ্গারা তাকে আজীবন স্বরণ রাখবে।  

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজকে জানান, এ হত্যাকাণ্ডে ৩৬ জনকে জড়িত হিসেবে শনাক্ত করা হলেও সাত জনের ঠিকানা ও অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

গ্রেফতার ১৫ জনের মধ্যে চারজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনজন সাক্ষীও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন বলেও জানান ওসি মোহাম্মদ আলী।  

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সক্রিয় ছিলেন মুহিবুল্লাহ:

পিপি ফরিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে জেনেছি, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে তার সোচ্চার ভূমিকা ছিল পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের কাছে মুহিবুল্লাহ জনপ্রিয় হয়ে উঠে, যে কারণে প্রত্যাবাসন বিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা সদস্যরা তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।

 তিনি বলেন, যে ২৯ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে এরা সবাই আরসার সদস্য এবং আরসা প্রধান জুনুনীর নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।  

‘দেশে-বিদেশে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও প্রত্যাবাসন ইস্যুতে সক্রিয় নেতৃত্বে ছিলেন মুহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি মাস্টার মুহিবুল্লাহ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সুশিক্ষিত মুহিবুল্লাহ সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরসা। এজন্য তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ’ যোগ করেন পিপি।  

জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই ১৭ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৭ প্রতিনিধি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সে সাক্ষাতে রোহিঙ্গাদের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। একই বছরের ২৫ আগস্ট উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাদের জড়ো করে সমাবেশ করে তিনি আলোচনায় আসেন।

মিয়ানমারের সিটওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানি (উদ্ভিদবিদ্যা) বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে মুহিবুল্লাহ পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতা। তিনি নিজ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার প্রসারে রেখেছেন অনবদ্য ভূমিকা।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র হয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অধিকার নিয়ে কাজ করার কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারাও তাকে নেতা মানতো। তার তুমুল  জনপ্রিয়তা ও প্রত্যাবাস নিয়ে দেশে-বিদেশে সরব উপস্থিতি মেনে নিতে পারেনি মিয়ানমারের আরসা।  

কানাডায় গেলেন মুহিবুল্লাহর মাসহ আরও ১৪ জন:

মুহিবুল্লাহর পরিবারের ২৫ সদস্য কানাডায়: মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর তার পরিবারের সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তখন তারা তৃতীয় কোনো দেশে আশ্রয় চায় জাতিসংঘের কাছে। পছন্দের তালিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। এরপর তাদের গতবছরের ১৭ অক্টোবর ট্রানজিট ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ স্ত্রী নাসিমা খাতুন, নয় সন্তান ও এক জামাতাসহ ১১ জন সদস্য কানাডায় আশ্রয় পান।

সর্বশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহর মা উম্মে ফজল (৬০) ছোট ভাই হাবিব উল্লাহর স্ত্রী আসমা বিবি (৩৫), আরেক ভাই আহমদ উল্লাহর স্ত্রী শামছুন নাহারসহ তাদের পরিবারের ১৪ জন কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন।

রোহিঙ্গা শিবিরের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার বাদী তার ভাই হাবিবুল্লাহ ছাড়া পরিবারের সব সদস্য কানাডা চলে গেছেন। মামলার কারণে তাকে রাখা হয়েছে।  

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং-১ (ইস্ট) লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৮ ব্লকে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তার অভাবে তার ভাই রশিদ উল্লাহ পরিবারের সদস্যদের তৃতীয় কোনো দেশে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দুই দফায় পরিবারের ২৫ সদস্যকে কানাডায় স্থানান্তর করা হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২
এসবি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।