ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ মে ২০২৪, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সিনেমাপ্রেমীদের আক্ষেপ ঘুচাতে চালু হচ্ছে ‘রাজ তিলক’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০২২
সিনেমাপ্রেমীদের আক্ষেপ ঘুচাতে চালু হচ্ছে ‘রাজ তিলক’ ‘রাজ তিলক সিনেমা হল।

রাজশাহী: লোকসানের বোঝা নিয়ে ২০১০ সালের পর একে একে বন্ধ হতে থাকে রাজশাহীর সিনেমা হলগুলো। সর্বশেষ ‘উপহার’ সিনেমা হলটি বন্ধ হয় ২০১৮ সালে।

এরপরই সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত ছিলেন রাজশাহীবাসী। রাজশাহীতে কোনো সিনেমা হল অবশিষ্ট না থাকায় এখানকার সিনেমা দর্শকদের ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে ছুটে যেতে দেখা গেছে। তবে সিনেমাপ্রেমীদের বেশিরভাগই বঞ্চিত থেকেছেন।  

তাদের আক্ষেপ দূর করতে ২০১২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে পবা উপজেলার কাটাখালীর ‘রাজ তিলক’ সিনেমা হলটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে হলটি বন্ধ হয়ে পড়ে ছিল। সম্প্রতি মালিকের কাছ থেকে পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া এলাকার সাজ্জাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি চলচ্চিত্রে ‘প্রোডাকশন ম্যানেজার’ হিসেবে কাজ করেন। তিনি হলটি চালুর উদ্যোগ নেওয়ার পর বর্তমানে সংস্কারের কাজ চলছে।

রোববার (১৬ অক্টোবর) সকালে শহরের উপকণ্ঠে থাকা কাটাখালী পৌর এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে কাটাখালী বাজারে হলটির সামনে গিয়ে দেখা গেল, শ্রমিকরা হল সংস্কারের কাজ করছেন। হলের সামনে টানানো হয়েছে ব্যানার। এতে রয়েছে শিগগির হল চালুর ঘোষণা।  

এই সিনেমা হলটির সংস্কার কাজের দেখভাল করছেন তত্ত্বাবধায়ক আক্কাস আলী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, হলটির সংস্কার কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে চলছে। অল্প দিনের মধ্যে চেয়ার বসানোর কাজ শুরু হবে। তারা আশা করছেন দ্রুতই কাজ শেষ করে হলটি চালু করা যাবে।

তিনি আরও বলেন, ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি এই সিনেমা হলে কর্মরত আছেন। নওগাঁর আজিজ খান নামের এক ব্যক্তি হলটি নির্মাণ করেছিলেন। আশির দশক ভালো ব্যবসা করেছেন। পরে ঢাকার শহিদুল হক সিকদার নামের এক ব্যক্তি হলটি কিনে নেন। আর তার কাছ থেকে হলটি কিনে নেন রাজশাহীর রানা ও দুলু নামের দুই ভাই। তাদের কাছ থেকে আনোয়ারুল হক নামের আরেকজন হলটি কিনে নেন। সবশেষ ২০১২ সালে ‘কমন জেন্ডার’ সিনেমা চলাকালে হলটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রুম্মান আলী হলটি কিনে নেন। যদিও তারপর আর হলটি চালু হয়নি।  

লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া হলটি ভাড়া নেওয়া সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তিনি রাজ তিলককে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সিনেমা হল হিসেবে গড়ে তুলতে চান। সংস্কার কাজ চলছে। অল্পদিনের মধ্যে চেয়ার বসানোর কাজ শুরু হবে। হলটিতে একসঙ্গে ৬০০ মানুষ বসে সিনেমা দেখতে পারবেন। ব্যবসা ভালো হলে ভবিষ্যতে সিনেপ্লেক্সও করার পরিকল্পনা আছে। চলতি মাসের শেষ দিকে কিংবা নভেম্বর মাসের শুরুতে নতুন কোনো চলচ্চিত্র দিয়ে হলটি পুনরায় উদ্বোধন করার ইচ্ছের কথাও জানান তিনি।  

এদিকে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের কথা বলে জানা যায়, রাজশাহীতে চলচ্চিত্রচর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। এখানে ঋত্বিক কুমার ঘটকের মতো অনেক গুণী মানুষের জন্ম। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজশাহীতে সিনেমা হলগুলো তৈরি হতে থাকে। সর্বশেষ উপহার সিনেমা হলের বয়স অর্ধশত বছরের কাছাকাছি। আশির ও নব্বইয়ের দশকেও রাজশাহীর সিনেমা হলগুলোতে সগৌরবে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। তবে বর্তমান শতাব্দীর শুরুর দিকে এসে সিনেমা হলগুলোর ‘অপমৃত্যু’ ঘটতে থাকে। ১৯৯১ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী রাজশাহী মহানগরীসহ জেলায় সিনেমা হল ছিল ৫৫টি। মানসম্মত সিনেমা ও দর্শকের অভাবে একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে সিনেমা হল। সর্বশেষ স্মৃতি সিনেমা হল, বর্ণালী সিনেমা হল, কল্পনা সিনেমা হল ও উপহার সিনেমা হল বন্ধের পর বর্তমানে কোনো সিনেমা হল নেই।

মহানগরীতে প্রেক্ষাগৃহ ছিল ৬টি। এগুলোর মধ্যে অলকা পরবর্তী নাম স্মৃতি, কল্পনা পরবর্তী নাম উৎসব, স্নিগ্ধা পরবর্তী নাম উপহার এবং বর্ণালী ও লিলি। এছাড়াও মহানগরের উপকণ্ঠে কাটাখালীতে নতুন পরবর্তী নাম রাজতিলক এবং নওহাটায় দুটির একটি নাম ছিল বাবুল ও অপরটি লিলি। এগুলোর মধ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রেক্ষাগৃহটি ছিল রাজশাহীর বর্ণালী সিনেমা হল।

২০০৭ সালে শহরের সবচেয়ে পুরনো প্রেক্ষাগৃহ স্মৃতি সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে রাজশাহীর ভিক্টোরিয়া ড্রামাটিক ক্লাবের উদ্যোগে নাট্য আন্দোলন এগিয়ে নিতে নির্মিত হয়েছিল ‘রাজা প্রমথনাথ টাউন হল’। প্রতিষ্ঠা থেকে সেখানে নিয়মিত বাংলা সাহিত্য ও নাট্যচর্চা হতো। ১৯১৯ সালের ২ এপ্রিল ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাছ থেকে হলটি কিনে নেয় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন। পরে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে অলকা সিনেমা হল নামে যাত্রা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে স্মৃতি সিনেমা হল নামে হলটির নামকরণ হয়। পরে ওই হল ভেঙে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন বহুতল ভবণ নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে।

মহানগরীর আলুপট্টির উৎসব সিনেমা হলে ২০১০ সালের জুলাইয়েও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। পরে তা ভেঙে স্বচ্ছ টাওয়ার নামে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। নগরীর কাদিরগঞ্জ ও আমবাগানের মধ্যবর্তী এলাকায় ছিল বর্ণালী সিনেমা হল। বর্তমানে হলটি না থাকলেও শহরের ওই এলাকার নামকরণ রয়েছে বর্ণালীর মোড় নামেই। শহরের পাশেই মোল্লাপাড়ার লিলি সিনেমা হলটিও আর নেই। সেখানে করা হয়েছে মার্কেট।

রাজ তিলক হলটি চালু হলে রাজশাহীর চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আক্ষেপ মিটবে বলে মনে করেছেন আলোচিত ‘শাটিকাপ’ ওয়েব সিরিজ নির্মাতা মো. তাওকীর ইসলাম।  

তিনি বলেন, রাজশাহী শিক্ষানগরী এবং সাংস্কৃতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এ জায়গার মানুষ ছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। এ রকম একটি জায়গায় একটি সিনেমা হল না থাকা মেনে নেওয়াই কঠিন। রাজশাহীতে একটি সিনেমা হল চালু হচ্ছে, এটা আনন্দদায়ক বিষয়। বর্তমানে দেশীয় সিনেমার জোয়ার চলছে৷ তাই রাজশাহীতে সিনেমা হল থাকাটা এখন সংস্কৃতি কর্মীদের প্রাণের দাবি।

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।