নিউইয়র্ক: ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষের কাছে ‘অসীম শ্রদ্ধার পাত্র’ ছিলেন বলেই মনে করতো মার্কিন কূটনীতিক মহল। তার দেওয়া ৭ মার্চের ভাষণকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেওয়ার ঘোষণার সামিল বলে মনে করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন নথির ৩৩৫টি আপডেট ভলিয়্যুমের অংশবিশেষে এমন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গিয়েছিলো, যে যুদ্ধে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান জড়াতে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই তার পরিসমাপ্তি ঘটবে।
‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’-- মুজিবের এই ডাক বাঙালিকে সেদিন যে কোনো শক্তিকে পরাস্ত করার শক্তি যুগিয়েছিল বলে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে গত ৩১ মার্চ, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত নথিতে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এসব গোপন (ক্লাসিফায়েড) তথ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রিচার্ড নিক্সন, ব্রেজনেভ, ইয়াহিয়া খান, ইন্দিরা গান্ধী, হেনরি কিসিঞ্জারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কথোপকথন, চিঠি , আলোচনা ও প্রতিদিনের ঘটনাবলীর বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে।
নথিতে বলা আছে, ৭ মার্চের ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে ৩শ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবেই আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষমতা কার্যত নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে।
এতে উল্লেখ রয়েছে, শেখ মুজিবের ঘোষণাতে প্রশাসনিক ক্ষমতা নিতে ৩৫টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল, যেখানে পরিষ্কার বোঝা গেছে, পরিকল্পিতভাবেই এবং সতর্কতার সাথে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক অধিকারের ভিত্তিতে দেওয়া জনগণের রায় শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পদক্ষেপ নেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
নথিতে উল্লেখ রয়েছে, মুজিব তার ঘোষণায় সম্ভাব্য সব পন্থায় বাঙালিদের তাদের উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন। এছাড়া মুজিব এককভাবেই (ভুট্টোকে ছাড়াই) ইয়াহিয়া তথা পাক সরকারের সামরিক আইনকে অগ্রাহ্য করছেন।
নথির একটি অংশে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সিসকো ১৯৭১ এর ১৫ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি রজার্সকে জানিয়েছিলেন, “পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে ৩শ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবেই আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। মুজিবের ঘোষণায় প্রশাসনিক ক্ষমতা নিতে ৩৫টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, যাতে পরিষ্কারভাবে বোঝা গেছে, পরিকল্পিতভাবেই এবং সতর্কতার সাথে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মুজিব একক ভাবেই ইয়াহিয়া তথা পাক সরকারের সামরিক আইনকে অগ্রাহ্য করেছেন।
ড. সিসকো এ-ও জানিয়েছিলেন ডিসেম্বরের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক মত প্রকাশে জনগণের রায়ের ভিত্তিতেই স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে মুজিব তার পদক্ষেপ নিয়েছেন।
‘ ইয়াহিয়া সরকারের অবশ্যই উচিত দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া’ এ-মন্তব্য করে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন আরও জানিয়েছিলেন, মুজিবের সাথে কথা বলতে ইয়াহিয়া ঢাকার উদ্দেশ্যে উড়াল দিয়েছেন।
এর আগে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারকে পাঠানো একটি স্মারকে(মেমোরেন্ডামে) ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দুই সদস্য হ্যারল্ড সন্ডার্স এবং স্যামুয়েল হসকিনসন, পাকিস্তানের ভয়াবহ সংকটের কথা প্রসংগে লিখেছিলেন, “ভবিষ্যতে ঘটনাবলী কি হবে তা এখন প্রধানত নির্ভর করছে মুজিবুর রহমানের এবং পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের ওপর। ঢাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং জানা গেছে, স্বাধীনতার ডাকের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল এবং বিক্ষোভ চলছে। ”
নথিতে পাওয়া গেছে ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার মার্চ মাস থেকেই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ-এর জন্মের বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী বলেেএকপ্রকার স্বীকারই করে নিয়েছেন। তাদের আলোচনায় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ না বলে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয় বিভিন্নভাবে।
১৯৭১’র ৩ জুনের একটি নথিতে হেনরি কিসিঞ্জার ও ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কেটিং’র কথোপকথন রয়েছে। এতে বিরাজমান পরিস্থিতি রাজনৈতিক স্থায়িত্ব অর্জনের পথ কি না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করায় রাষ্ট্রদূত কেনেথ কেটিং তখন কিসিঞ্জারকে বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানিরা মুজিবুর রহমানের বিষয়ে হীনমন্যতা দেখাচ্ছে। কিন্তু মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে অসীম শ্রদ্ধার পাত্র।
জবাবে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে ধরে রাখতে পারবে এমন দিবাস্বপ্ন(‘ইল্যুশন’) আমাদের নেই। এবং তাদের ব্যাপারে আমাদের কোনো আগ্রহও নেই।
বাংলাদেশ সময় ১৬৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৪
** যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি: স্বাধীনতা ঘোষণা করেন শেখ মুজিব
** যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথিতেও ‘রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব’